মানবসভ্যতায় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন অমর সংস্কার হিসেবে বরিত, তেমনি সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য। নবীজি (সা.)-এর জীবনী বা সিরাতের পরতে পরতে পাওয়া যায় এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত। নবীজির ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্য-প্রতিভা ছিল আল্লাহপ্রদত্ত। মহান আল্লাহ সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি সব নবীকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের জাতিকে সুস্পষ্টরূপে বোঝাতে পারেন।’ (সুরা ইব্রাহিম: ৪)। বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন জ্ঞানের জগতের এক অনুপম সম্রাট। তার এ জ্ঞানের উৎস সৃষ্টির যিনি মহান কর্তা, বিশ্বজগতের পরিচালক, নিয়ন্ত্রণকারী, অন্নদাতা, বিধানদাতা, বিশ্ব প্রতিপালক মহান রাব্বুল আলামিন স্বয়ং নিজে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং সত্যের প্রতি ভালোবাসায় তিনি তার প্রেমাস্পদের অন্তরের বিপুল বিস্তারকে দীর্ঘ রেখেছেন অষ্টপ্রহর। মানবতার এ মহান শিক্ষক ছিলেন সর্বদা সত্য ও সুন্দরের উপমা। তিনি নিজে ছিলেন সুন্দর, তাই সুন্দরকে আঁকড়ে ধরেছেন সযত্নে। যেখানে সুন্দরের আনাগোনা সেখানেই তার পদচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। এই পরিপ্রেক্ষিতে কাব্য এবং সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তার এক অনন্য সৃজনশীল রুচির পরিচয় বহন করে। কারণ সাহিত্য মানুষের সৃজনী প্রতিভার সরব প্রকাশ। ভাব যখন ভাষা পায়, তখনই তা সাহিত্য হয়ে উঠে আসে।
প্রতিভার এই বিকাশ এবং প্রকাশ সাহিত্যের নানা মাধ্যমে হতে পারে। গদ্য, পদ্য, কবিতা-ছড়া, গল্প, উপন্যাস সব বিষয়ে। অবশ্য পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার ‘সাহিত্য’ কবিতা তথা কাব্যকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। আরবি সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। আর নয় বলেই রাসুল (সা.)-এর উত্থানের সময়কালে আরবে কাব্য ধারাটি ছিল প্রবল। ওই সময়ে বেশিরভাগ কাব্যের প্রধান বিষয় ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অশ্লীলতা, কাম, ক্রোধ, সম্পদ লুণ্ঠন, অন্যের বিরুদ্ধে উসকানি, গোলযোগ সৃষ্টি, বিপদে ফেলা ইত্যাদি। সে যুগে কাব্যচর্চা এমন এক রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, খ্যাত-বিখ্যাত ওকাজের মেলা কেন্দ্র করে কবিদের মধ্যে চলত বড়ত্বের লড়াই বা কবিতাযুদ্ধ। প্রতি বছর যে সাতজন কবির কবিতা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় উন্নীত হতো, সেই সাত কবির কবিতা মিশরের মিহি কাপড়ে সোনার হরফে লিখে কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং এর সংকলনের নামকরণ করা হতো ‘সাবউল মুয়াল্লাকা’। সাবউল মুয়াল্লাকার সাতজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন—ইমরাউল কায়েস, তুরফা, জুহায়ের ইবনু আবু সালমা, লবিদ, আমর ইবনু কুলসুম, আনতারা ইবনু শাদ্দাদ, নাবিগা ইবনু জুবিয়ানি প্রমুখ। (আরবি সাহিত্যের ইতিহাস, আ ত ম মুসলেহ উদ্দিন: ২৫-৩২ পৃষ্ঠা)।
কবিতায় যখন আরবের কাব্যবাজার রমরমা, যুবসমাজ কবিতায় প্লাবিত, তখনই রাসুল (সা.) লাভ করেন নবুয়ত-রিসালত; নবী হিসেবে হয় তার আবির্ভাব। নাজিল হতে থাকে পবিত্র কোরআন, যা ছিল মানবের বোধের উৎস, অন্ধকারে আলোর ঔজ্জ্বল্য এবং কাব্যরীতির এক অনুপম উপমা। আরবের ভিনধর্মী কবি-সাহিত্যিকরা শুরু করেন চেঁচামেচি। নবীজির ওপর তোলা হয় অসংখ্য প্রশ্ন। তিনি নিরক্ষর, কবি-সাহিত্যিক কিছুই নয়, তার মুখনিঃসৃত মহাসাহিত্যের কোরআনিক কথাগুলো কোথায় পান? এ কথাগুলোর সামনে আমাদের উচ্চমার্গের কবিতাগুলো তুলে ধরাই যাচ্ছে না! এসবের মধ্যেই কোরআনের চ্যালেঞ্জ ঘোষিত হলো—‘শুধু তোমরা কেন, সমগ্র পৃথিবী থেকে তোমাদের সহযোগিতার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের একত্রিত করে দেখো; কোরআনের মতো ছোট একটি সুরা লিখতে পারো কি না?’ (সুরা বাকারা: ২৩)। তখনো পৃথিবী পারেনি, এখনো না, ভবিষ্যতেও পারবে না। অথচ ওই সময়ে আরবের কবিসমাজের প্রভাব প্রতিপত্তি এত তীক্ষ্ণ ও প্রখর ছিল যে, তারা যা বলতেন সাধারণ মানুষ তাই আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করত।
মহানবী (সা.) জন্মেছিলেন কবি ও কবিতার ভুবনখ্যাত মক্কার নগরীর শ্রেষ্ঠ গোত্র কুরাইশে; ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে। সময়টা ছিল খুব অস্থির কিন্তু তিনি ছিলেন পাপ-পঙ্কিল অন্ধকার পৃথিবীতে আলোক বিচ্ছুরিত এক দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব। কি মেধায়, কি মননে, কি ভাষায়, কি আচরণে, সর্বত্র অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে যেখানে সুন্দরের উপস্থিতি সেখানে তার উৎকৃষ্টতা। যেখানে শক্তির বাহাদুরি সেখানে তার উত্তমত্তা। যেখানে ভাষার উন্নীতকরণে বছরকে বছর চলত কাব্যযুদ্ধ সেখানে তাকে ঘিরেই ভাষা রূপ নেয় আধুনিক সাহিত্যে। ভাষার উন্নতরূপকে যে সাহিত্য বলে এ কথাটি প্রথম তার মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়। তার আগে ভাষার উন্নতরূপকে ভিন্ন ভিন্ন শব্দে-বাক্যে বোঝানো হতো। বিশ্বনবী (সা.)-এর অনুপম কথামালা, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, উৎকর্ষ আচরণ, উন্নত ভাষাশৈলী দেখে সাহাবিরা অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, আপনি এসব কোথা থেকে লাভ করেছেন? উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন,Ñ‘আদ্দাবানি রাব্বি ফা-আহসানা তাদিবি’, অর্থাৎ, “আমার প্রভু আমাকে এ ‘আদব’ শিখিয়েছেন এবং তিনি আমাকে সুন্দরভাবেই শিখিয়েছেন” (আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআহ: ১০২০)। আরবি ‘আদব’ শব্দকে বাংলায় সাহিত্য বলে। তা ছাড়া আদব শব্দরে মধ্যে শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, আচার, নৈতিকতার মতো অতিরিক্ত কিছু ভাব আছে। যে যুগে বিখ্যাত ওকাজের মেলা কেন্দ্র করে কবিদের মধ্যে চলত বড়ত্বের লড়াই বা কবিতাযুদ্ধ, সে যুগেই জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বনবী (সা.)। মহানবী (সা.)-এর পিতা-প্রপিতামহসহ ঊর্ধ্বতন ১৭ জন পুরুষ সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুণী কবি ছিলেন। ইতিহাস ও সিরাত গ্রন্থে যার দালিলিক বিস্তারিত আলোচনা আছে। মহানবী (সা.)-এর মাতা হজরত আমেনা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। রাসুলের পিতা আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর তিনি কয়েকটি শোকগাথা গেয়েছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
শিল্পসাহিত্যের প্রতি বিশেষ করে কবিতার প্রতি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ছিল এক সহজাত আকর্ষণ। ওহুদ যুদ্ধের প্রথম দিকে মহানবী (সা.) হাতের একটি আঙুলে ব্যথা পেলে হঠাৎ আবৃত্তি করেন, ‘হে অঙ্গুলি! তুমি তো একটি আঙুল বৈ কিছুই নও। সুতরাং যা কিছু হয়েছে তা আল্লাহর রাস্তায় হয়েছে; অনুশোচনা ও দুঃখ কীসের?’ (তিরমিজি: ৫/১৩৯)। খন্দক যুদ্ধে সাহাবিরা যখন পেটে পাথর বেঁধে আত্মরক্ষার জন্য পরিখা খনন করছিলেন, তখন তাদের কষ্ট দূর করত সান্ত্বনা প্রদানে মহানবী (সা.) আবৃত্তি করতে থাকেন—‘হায় আল্লাহ, আখিরাতের জীবনই তো আসল জীবন, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন। হায় আল্লাহ, আখিরাতের কল্যাণই তো আসল কল্যাণ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের বরকত দান করুন।’ (বোখারি: ২/৫৮৮)। হুনায়েনের যুদ্ধ ময়দানে সৈন্যদের উদ্দেশে আবৃত্তি করতে থাকেন—‘আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই; আমি আবদুল মুত্তালিবের উত্তরসূরি।’ (বোখারি: ২/৬১৭)। এ ছাড়া সহিহ বোখারিতে মহানবীর আওড়ানো অনেক কবিতার কথা উল্লেখ আছে। এ কবিতাগুলো ছিল মহানবী (সা.)-এর স্বরচিত কবিতা।
কবি হাসসান ইবনু সাবিত ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সভাকবি। মহানবী (সা.) যখন গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন যে, জাহেলি যুগের ওইসব কবির মোকাবিলা একমাত্র কবিতা দিয়েই সম্ভব, তখনই তিনি কাব্য এবং সাহিত্যচর্চার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন। সুরা শোয়ারা নাজিল হওয়ার পর হাসসান ইবনু সাবিতসহ সাহাবি কবিরা কাঁদতে শুরু করেন। রাসুল (সা.) কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা ওই সুরার প্রথম অংশের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তাতে বলা হয়েছে—‘কবিদের অনুসরণ করে যারা, তারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখো না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে, যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ (সুরা শোয়ারা: ২২৫-২৭)। একশ্রেণির লোক আয়াতের প্রথম অংশ পড়ে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে, তারা আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তারা বলে ওঠেন—দেখলেন, আল্লাহ কবিদের কেমন অপছন্দ করেন? এসব ব্যক্তি যদি আরও একটু ধৈর্য ধরে আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়তেন, তবে তারা দেখতে পেতেন—‘তবে তারা ছাড়া’ বলে আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ আরেক দল কবির কথা উল্লেখ করেছেন, যারা আল্লাহর অপছন্দনীয় তো নয়ই, বরং আল্লাহর বিশেষ কৃপাধন্য। এসব কবির করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ সরাসরি গাইডলাইন-নির্দেশনা দিয়েছেন উল্লিখিত আয়াতে। আল্লাহর নির্দেশনা ও গাইড যারা মেনে চলে, তারাই তো যথার্থ ইমানদার এবং এ ধরনের লোকদের সাফল্য নিশ্চিত।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
শুক্রবার দৈনিক কালবেলার ইসলামবেলায় প্রকাশিত ‘সাহিত্যচর্চায় নবীজির প্রভাব ও অবদান’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর আমলের সাহিত্যিকের একটি প্রতিচ্ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। এটাকে অনেকেই নবীজির ছবি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা অসত্য ও দুঃখজনক। তবুও এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। দ্র: বি.স