হজরত ইসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তার ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল আসমানি কিতাব ইনজিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৫৫০ বছর পূর্বে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। আল্লাহর আদেশে তাকে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নেওয়া হয়। কেয়ামতের পূর্বে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন। ইসা (আ.) ফিলিস্তিন ও শাম অঞ্চলের মানুষকে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতেন। ইসা (আ.)-এর মুখনিঃসৃত তাওহিদের বাণী শুনে তার অনুসারী বাড়তে থাকে। তবে আগে থেকেই তার প্রতি বিরূপ ইহুদিরা আরও বিরূপ হতে থাকে। বনি ইসরাইলের ইহুদিরা ইসা (আ.)-এর বিরোধিতায় ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তাকে জাদুকর বলে আখ্যায়িত করে। সে সময় শাম অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ইসা (আ.)-এর তাওহিদের দাওয়াত ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় শাসকশ্রেণি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সে সময়ের রোমান সম্রাট দাউদ ইবনে নুরের নির্দেশে ইসা (আ.)কে গ্রেপ্তারের জন্য সরকারি সেনারা বায়তুল মুকাদ্দাসে ইসা (আ.)-এর হুজরা (কামরা) ঘেরাও করে। সেদিন ছিল শনিবার। রাতে খাবারের পর ১২ ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনার পর একজনের বিশ্বাসঘাতকতায় ইহুদিরা তার অবস্থানের সন্ধান পেয়ে যায়। তখন আল্লাহতায়ালা বাড়ির ওপরের ছাদ উন্মোচিত করে ফেরেশতার মাধ্যমে আসমানে তুলে নেন তাকে। সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে ইসাকে (আ.) ধরে আনার জন্য একজনকে ভেতরে পাঠায়। ভেতরে সে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা পরিবর্তন করে ইসা (আ.)-এর মতো করে দেওয়া হয়। আর তাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীরা। তারপর তারা ইসা (আ.)কে হত্যার মিথ্যা দাবি প্রচার করতে থাকে। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২/১৮১-৮৬)। আল্লাহ বলেন, তারা বলে যে, ‘আমরা মাসিহ ইসা ইবনে মারিয়ামকে হত্যা করেছি। তাদের এ কথা ভুল। আসলে তারা তাকে হত্যাও করেনি, শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদের কাছে ইসা (আ.)-এর সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য একজনকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তারা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যে বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত সে বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধুই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা আসলে নিশ্চিতভাবে ইসাকে হত্যা করতে পারেনি। বরং আল্লাহ তাকে আসমানে তুলে নিয়েছেন।’ (সুরা নিসা: ৫৭-৫৮)।
কেয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে, পৃথিবীতে ঈসা (আ.)-এর পুনর্বার আগমন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইসার পুনরায় দুনিয়ায় আগমন কেয়ামতের একটি নিশ্চিত নিদর্শন।’ (সুরা জুখরুফ: ৬১)। মিরাজের রাতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) চতুর্থ আসমানে হজরত ইসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হজরত ইসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি আমাকে বললেন—কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে তা তো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে তিনি আমাকে এটা জানিয়েছেন, কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তখন আমি পৃথিবীতে অবতরণ করে দাজ্জালকে হত্যা করব।’ (ইবনে মাজা: ৪০৮১)। আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) দাজ্জালের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘দাজ্জাল যখন মুসলমানদের ইমান ধ্বংসের কাজে লিপ্ত থাকবে আল্লাহতায়ালা তখন ইসা ইবনে মারিয়ামকে (আ.) পাঠাবেন। জাফরানের রঙে রাঙানো এক জোড়া পোশাক পরিহিত হয়ে এবং দুজন ফেরেশতার পাখার ওপর হাত রেখে দামেস্ক শহরের পূর্বে অবস্থিত সাদা মিনারের ওপর তিনি অবতরণ করবেন। তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন সদ্য গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তির মাথা থেকে যেভাবে পানি ঝরতে থাকে সেভাবে তার মাথা থেকে পানির ফোঁটা ঝরতে থাকবে এবং যখন মাথা উঁচু করবেন তখন অনুরূপভাবে তার মাথা থেকে মণিমুক্তার মতো চকচকে পানির ফোটা ঝরতে থাকবে। কাফেরের শরীরে তার নিঃশ্বাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাফের মৃত্যুবরণ করবে। চোখের দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত গিয়ে তার নিঃশ্বাস শেষ হবে। তিনি দাজ্জালকে খুঁজবেন এবং ফিলিস্তিনের লুদ শহরের ফটকে তাকে ধরে ফেলবেন। অতঃপর তাকে সেখানে হত্যা করবেন। তারপর তার কাছে এমন কিছু লোক আসবেন যাদের আল্লাহতায়ালা দাজ্জালের ফেতনা থেকে হেফাজত করেছেন। তিনি তাদের চেহারায় হাত বোলাবেন এবং জান্নাতে তাদের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দেবেন।’ (মুসলিম: ২৯৩৭)।
হজরত ইসা (আ.) সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত উমাইয়া জামে মসজিদে আগমন করবেন। বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্য আদি অবকাঠামোর ওপর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। এর বয়স ১ হাজার ৩০০ বছরের বেশি। এ মসজিদকে ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সারা বিশ্বে। হজরত ইসা (আ.) দামেস্কে অবতরণের পর পৃথিবীতে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে বসবাস করবেন, জাতির নেতৃত্ব দেবেন এবং অন্যান্য মুসলমানের মতোই মৃত্যুবরণ করবেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘ইসা (আ.) পৃথিবীতে আগমনের পর বিয়েশাদি করবেন এবং তার সন্তানাদিও হবে। এরপর তিনি ইন্তেকাল করবেন। আমার রওজায় তার কবর হবে। সুতরাং আমি ও ইসা পুনরুত্থিত হবো আবু বকর ও উমরের মাঝে।’ (মেশকাত: ৪৮০)।