বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিন দিন সরকারবিহীন অবস্থায় ছিল দেশ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠান রাষ্ট্রপতি। পরে এ বিষয়ে শুনানি করে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন মর্মে মতামত দেন। এরপর দেশের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে গত বছর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টার শপথ পাঠ করান। সুপ্রিম কোর্টের এই রেফারেন্সের (মতামতের) মাধ্যমেই অন্তর্বর্তী সরকার আইনি বৈধতা পেয়েছে।
এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ওই রেফারেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটও করেন এক আইনজীবী। আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদের করা ওই রিট গত ১৩ জানুয়ারি খারিজ করে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো আইনি দলিল দিয়ে সমর্থিত নয় বলে রিট আবেদনকারীর বক্তব্যে এসেছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এক ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপদেশমূলক মতামত গ্রহণ করেন। মতামত অনুযায়ী কাজ করেছেন। তাই এটি আইনি দলিল দিয়ে সমর্থিত, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার দ্বারা সমর্থিত। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, তা আমাদের ইতিহাসের অংশ এবং আশা করি আগামী বহু বছর ধরে জনগণ যত্নে থাকবে। রিটটি ভ্রান্ত ধারণা, বিদ্বেষপ্রসূত ও হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করে তা সরাসরি খারিজ করা হয়।
গত বছর ৬ আগস্ট বিকেলে রাষ্ট্রপতি দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দেন। এতে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়। এর আগে এমন সাংবিধানিক সংকট রেখে কোনো প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে পালিয়ে যাননি। আবার সংবিধানেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো বিধান ছিল না। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সে সময় এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবীর মতামত নেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আইনজীবীরা ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ারের বিষয়ে বলা আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সে সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।’ আইনজীবীদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে গত বছরের ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতার প্রশ্নে মতামত (রেফারেন্স) চাওয়া হয়। পরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা ভার্চুয়ালি আদালত বসিয়ে মতামতের বিষয়ে শুনানি করেন। সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে মতামত দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল রেফারেন্স প্রদান করেন। সুপ্রিম কোর্টের মতামত ও বৈধতা পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি ৮ আগস্ট রাত সোয়া ৯টার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করান।
স্পেশাল রেফারেন্সে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি বলেন, দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ০৮/০৮/২০২৪ তারিখের ১০.০০.০০০০.১২৭, ৯৯.০০৭.২০.৪৭৫ নং স্মারকে প্রেরিত পত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের বক্তব্য শোনা হলো। এ অবস্থায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো বিধান না থাকায় উল্লিখিত প্রশ্নের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ মতামত প্রদান করছে যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উক্তরূপে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টার শপথ পাঠ করাতে পারবেন।’
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এ রেফারেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ গত ডিসেম্বরে হাইকোর্টে রিট করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষের ভাষ্য, যে বিষয় (অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) সংবিধানে নেই, সে বিষয়ে রেফারেন্স চাওয়া যায় না। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রেফারেন্সের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রুলস অনুসরণ করতে হবে। আপিল বিভাগের রুল অনুসারে, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অন্যদের নোটিশ দিয়ে শুনানি করতে হবে। শুনানির জন্য নোটিশ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য, রেফারেন্সের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নোটিশ করা হয়েছিল। তিনি শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরে হাইকোর্ট রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে রায় দেন।
মন্তব্য করুন