বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বেশিরভাগ সড়ক-গলিতে আছে ভারীশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প, গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান, টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি, ইপিজেড। রয়েছে জাহাজ-ভাঙা শিল্পপ্রতিষ্ঠানও। যার সংখ্যা কম করে হলেও সাত হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বা জড়িত অন্তত ৩০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ভোটারের সংখ্যাই ন্যূনতম ১০ লাখ। তাই জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর হতে পারেন এসব ভোটার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড), চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-খুলশী) ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের প্রার্থীদের বেশিরভাগই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক, অংশীদার কিংবা ব্যবস্থাপনায় জড়িত। ফলে ভোটের মাঠের সমীকরণ পাল্টাতে সিংহভাগ ভোটের এই ব্যাংকেই নজর পড়েছে প্রার্থীদের।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের নৌকার প্রার্থী এমএ লতিফ বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভোটার রয়েছেন। গার্মেন্টসও রয়েছে অনেক। ভোটারও রয়েছে অনেক। আশা করছি, সবাই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন কালবেলাকে বলেন, এখানে নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা নানাভাবে হুমকি, আগুন দিয়ে ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়াসহ নানা ঘটনা ঘটাচ্ছেন। এতে বিভিন্ন শ্রমিকরা নিরাপত্তা, হুমকির কারণে ভোটকেন্দ্রে আসা নিয়ে অনিশ্চয়তায় দেখা দিয়েছে। তবে শিল্পকারখানার শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে বিশাল সংখ্যার ভোটার। তাদের ভোটেও রয়েছে নানা সমীকরণ।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনের নৌকা প্রার্থীর এস এম আল মামুন বলেন, নির্বাচনের দিন বিভিন্ন শিল্প অফিস বন্ধ থাকলেও সেখানে কর্মরত ভোটাররা ভোট দিতে আসবেন। শিল্পগ্রুপে কর্মরত বিশাল অংশের শ্রমিকদের ভোট রয়েছে। আশা করছি ভোটাররা চলমান উন্নয়নসহ নানা বিষয় বিবেচনা করেই যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করবেন।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকারখানার মধ্যে ভারীশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩২৮, ক্ষুদ্রশিল্প
৪৩২৩, গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি ৬৪৭, ইপিজেড তিনটি ও জাহাজ-ভাঙাশিল্প ৮০টি। এগুলো ছাড়াও কর্মী বেশি এমন সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে রয়েছে সাত হাজারের বেশি শিল্পকারখানা। যেখানে কর্মরত বা জড়িত রয়েছে ন্যূনতম ৩০ লাখ মানুষ। বেসরকারি গবেষণার তথ্যমতে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চট্টগ্রামের ভোটার সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
সমুদ্রঘেঁষা চট্টগ্রাম-৪ আসনে গার্মেন্টস, উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা, শিপ ব্রেকিংসহ দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মোট ভোটার ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৭২ জন। ১২৪ ভোটকেন্দ্র ভোট দেবেন তারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশনে জমা দেওয়া এই আসনের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আল মামুনের রয়েছে শিপ ব্রেকিং, হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ও ট্রেডিংয়ের ব্যবসা। সেখানে কর্মরত রয়েছেন অনেক মানুষ। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ইমরানেরও রয়েছে কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালীর একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত আফজাল খান রহমান। তিনি বলেন,
আমাদের সবাইকে বলা হয়েছে পরিবারসহ কেন্দ্রে গিয়ে যেন ভোট দিই। আশা করি, আমাদের পছন্দের প্রার্থীই জয়লাভ করবেন।
চট্টগ্রামের বেশিরভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রাম-৮ আসন (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী)। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ আসনটির বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অন্তত তিন হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান। বোয়ালখালী, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ থানা মিলিয়ে এই আসনটিতে ভোটার রয়েছেন ৫ লাখ ১৫ হাজার ৫৭৩।
কমিশনে জমা দেওয়া এই আসনের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন জাতীয় পার্টির সোলায়মান আলম শেঠ। তার রয়েছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে আলোচনায় থাকা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তারও রয়েছে প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান।
নগরের কালুরঘাট শিল্প এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। প্রথম থেকেই আমরাও প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি। আমাদের যতজন ভোটার আছে সবাই আমরা ভোটকেন্দ্রে যাব।
ডবলমুরিং-পাঁচলাইশ ও পাহাড়তলী থানার নিয়ে গড়ে ওঠা এ আসনটিতেও (চট্টগ্রাম-১০) রয়েছে হাজারখানেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান-কারখানা। এ আসনে ভোটার ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮০৩ জন। যাদের সিংহভাগই এসব এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ব্যাপক আলোচনায় থাকা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলমেরও রয়েছেন ২৫টির বেশি শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান।
যাদের এক তৃতীয়াংশই চট্টগ্রামের ভোটার। এই আসনে নীরব ফ্যাক্টর আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের ফরিদ মাহমুদও।
নগরের ডবলমুরিং এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রমেনা খাতুন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের মালিক খুবই ভালো মানুষ। আমরা চাই উনি জয়লাভ করুক।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনকেই মূলত বিভাগের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বলা হয়। এই আসনে বন্দরের পাশাপাশি রয়েছে হাজারখানেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তাদের সিংহভাগই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। আসনটিতে ভোটার ৫ লাখ ১ হাজার ৮৫২ জন। আসনটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম আব্দুল লতিফের রয়েছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যেখানে কাজ করছেন স্থানীয় অনেকে। এসব ভোট পেলে এগিয়ে থাকবেন লতিফ। অন্যদিকে শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি করা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনের রয়েছে বড় ভোট ব্যাংক। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের ওপর নজর তার।