নতুন ব্যবস্থাপনায় গ্রাহক ও আমানতের পরিমাণ বেড়েছে বেসরকারি ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল)। মাত্র পাঁচ মাসেই তিন লাখেরও বেশি নতুন গ্রাহক পেয়েছে ব্যাংকটি। বেড়েছে আমানতের পরিমাণও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আর্থিক সহায়তা ছাড়াই যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল) তখন সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক পরিচালকদের আর্থিক দুর্নীতির কারণে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তবে মাত্র পাঁচ মাসেই গ্রাহক যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আমানতের পরিমাণও। অন্যদিকে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারে পলাতক ভূমিমন্ত্রী ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। এরই মধ্যে দুদক ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক আট পরিচালকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে।
আদালতের আদেশে শুধু সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান এবং তার স্ত্রীই নয় ২৬টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইউসিবিএলের আরও সাতজন সাবেক পরিচালকের শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। সম্প্রতি দুদকের আবেদনে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের রায়ে মোট ৫৭০ কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। অবরুদ্ধ অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে ইউসিবিলের অন্য যেসব পরিচালক রয়েছেন তারা হলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরি জাভেদের স্ত্রী ও ইউসিবিএলের সাবেক চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান, বশির আহমেদ, আনিসুজ্জামান চৌধুরি, এম এ সবুর, বজল আহমেদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরি এবং রুক্সানা জামান।
দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজামান চৌধুরীর স্ত্রী, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের শেয়ারবাজারের লেনদেনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত ২৬টি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর ফলে এইসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারবেন না অভিযুক্তরা। দুদক সূত্রে জানা গেছে এসব অ্যাকাউন্টে মোট ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৭ টি শেয়ার রয়েছে। বর্তমান যার আনুমানিক মূল্য ৫৭৬ কোটি ৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এর আগে দুদকের উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা মশিউর রহমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭এর ১৮(১) ধারা অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আদেশ দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন।
জানা গেছে ২৬টি অবরুদ্ধ অ্যাকাউন্টের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামানের ৩১ লাখ ৯৩০ টি শেয়ার, বশির আহমেদের ৩১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫, সাবেক মন্ত্রীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরীর ৪৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯৭৩ টি, তার স্ত্রী রুক্সানা জামানের ৩১ লাখ ৩ হাজার ৮৯, এম এ সবুরের ৩৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৮, বজল আহমেদের ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪২, নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ৩১ লাখ ১ হাজার ৩৭৬, আসিফুজ্জামান চৌধুরীর ৪৩ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬৬টি শেয়ার রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সাতটি কোম্পানির বিও অ্যাকাউন্টও আদালতের আদেশের আওতায় এসেছে। এ কোম্পানিগুলো হলো ভলকার্ট ট্রেডিং লি. লিজেন্ডারি এসেট ম্যানেজমেন্ট লি, স্পেলেন্ডেড ট্রেডিং লি, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম, অর্ডেন্ট এসেট ম্যানেজমেন্ট লি, নাহার মেটালস লি ও এরোমেটিক প্রোপার্টিস লি। এই প্রতিটি কোম্পানিই সাইফুজ্জামান চৌধুরি বা তার পরিবারের মালিকানাধীন অথবা ঘনিষ্টদের মাধ্যমে পরিচালিত বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় ফিরে এলে ২০১৪ সালে পরই ইউসিবিএল-এর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার। ২০১৮ সালে পুরোপুরিভাবে ব্যাংকের দায়িত্ব নেয় তার পরিবার। নিজে মন্ত্রী হওয়ার পর স্ত্রী রুকমিলা চৌধুরীকে বানান ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
এ ছাড়া আদালতের আদেশে সাতটি কোম্পানির বিও অ্যাকাউন্টও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে: ভলকার্ট ট্রেডিং লি., লিজেন্ডারি এসেট ম্যানেজমেন্ট লি., স্পেলেন্ডেড ট্রেডিং লি., আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম, অর্ডেন্ট এসেট ম্যানেজমেন্ট লি., নাহার মেটালস লি. এবং এরোমেটিক প্রোপার্টিস লি। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, কোম্পানিগুলো সাইফুজ্জামান চৌধুরি বা তার পরিবারের মালিকানাধীন অথবা তাদের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে পরিচালিত।
পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন পরিবারের ঘনিষ্ঠরা—যেমন ভাইস চেয়ারম্যান বশির আহমেদ এবং তার ভাই বজল আহমেদ, যিনি নির্বাহী কমিটিতেও ছিলেন। বশির আহমেদের স্ত্রী তারানা আহমেদ মেঘনা ব্যাংক পিএলসি’র একজন পরিচালক। এদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, বিদেশি নাগরিকত্ব গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দুদকে তদন্ত চলছে।সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এম এ সবুর ২০১৬ সালের মার্চে ইউসিবির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য গত বছর গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাসহ পুরো মন্ত্রিসভার সদস্যরা পালিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার যে ১২টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে তার মধ্যে অন্যতম ইউসিবিএল। বর্তমানে ইউসিবিএলের নতুন পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে ৭ হাজার ৭৫০ কোটির বেশি নেট আমানত বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ছয় মাসে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন সাহায্য না নিয়েই ব্যাংকের এডি রেশিও ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ এ নেমে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার ৪২তম বার্ষিকী পালন করা ব্যাংকটিতে নানা নতুন উদ্যোগে গ্রাহকদের আস্থাও ফিরেছে।
তবে আদালত ও দুদকের মামলাগুলো সম্পর্কে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
মন্তব্য করুন