জাপান সরকার ও অন্যান্য বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কয়লা ও এলএনজি প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শ্যামলী পার্ক মাঠে এ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মূলত, জাপান সরকার এবং জাপানের অর্থলগ্নিকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- এমইটিআই, জেবিআইসি এবং জাইকা এশিয়ার ৪টি দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর তথা কয়লা বিদ্যুৎ ও এলএনজি প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ করছে। এই ৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
জাপানের অর্থায়ন এবং জ্বালানি নীতির উপর সরকারি বা বেসরকারি প্রভাব এশিয়ায় কয়লা ও গ্যাস বিস্তারের কারণ। এগুলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুাৈর জ্বালানি রূপান্তর এবং জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবেও কাজ করে। বর্তমান বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন মাসে জাপানের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের বিনিয়োগের জরুরি সব সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
এই বিনিয়োগের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রায় ১৭টি সংগঠন জাপান সরকারকে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বিনিয়োগ বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগে সচেতন করার উদ্দেশ্যে উপরোক্ত কর্মসূচি আয়োজন করে।
কর্মসূচির আয়োজক সংগঠনগুলো হলো ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, ব্রাইটার্স, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি), সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পল্যুশন স্ট্যাডিস (ক্যাপস), ইকুইটিবিডি, গ্লোবাল ল’ থিংকারস সোসাইটি (জিএলটিএস), খাসিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (কেএসইউ), মিশন গ্রীন বাংলাদেশ, অর্গানাইজেশন ফর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট কনজার্ভেনশন (ওসিআরইসি), সচেতন ফাউন্ডেশন, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, ইয়াং ক্লাইমেট একশন নেটওয়ার্ক (ইউক্যান), থ্রিফিফটি ডটঅরগ, রিভার বাংলা ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন শরীফ জামিল, মোস্তফা কামাল আকন্দ, আব্দুল করিম কিম, ফয়সাল আহমেদ, রাওমান স্মিতা, নিখিল চন্দ্র ভদ্র, এএসএম বদরুল আলম, সাইদুর রহমান সিয়াম, মেহনাজ মালা, যুধিষ্টির চন্দ্র বিশ্বাস, আবু শাহদাত মোহাম্মদ সায়েম, নুর আতায়া রাব্বি, আহসান রনি, ব্লেস্মি বাড়ে, মনির হোসেন, ইকবাল ফারুক প্রমুখ।
সমাবেশে ধরা কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব শরীফ জামিল আয়োজনের উদ্দেশ্য তুলে ধরে মূল বক্তব্যে বলেন, জুন মাসে জাপানের কর্মপরিকল্পনা করা হয়। আমরা জানতে পেরেছি আবারও বাংলাদেশে অনেকগুলো এলএনজি টারমিনাল স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বিস্তারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা তা চাই না। আমরা চাই জাপান যেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প স্থাপনের দিকে ধাবিত হয়।
সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, ধরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাপানের প্রতারণামূলক বিনিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য সকল সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে অসংখ্য মানুষ জীবিকা হারাচ্ছে, তারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে।
বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন এর এএসএম বদরুল আলম বলেন, আমরা জানি জাপান বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, কিন্তু এর ফলে কি ক্ষতি হচ্ছে তা আমরা জানি না। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে উত্তরবঙ্গে খরা ও মরুকরণ হচ্ছে, ঋতুচক্রে পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অথচ জাপান ব্যবসায়িক কারণে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে কয়লা খাতে বিনিয়োগ করছে। আমরা আশা করি জাপান এই প্রকার বিনিয়োগ থেকে বের হয়ে আসবে।
মিশন গ্রিন বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকরা ফ্লাশমবএ অভিনয়ের মাধ্যমে কীভাবে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার স্বার্থে প্রকৃতির বিনাশ সাধন করছে তা তুলে ধরে। পরিবেশ উন্নয়নে পরিবেশবাদীদের ভূমিকাও তুলে ধরা হয়।
ব্রাইটারসের সাইদুর রহমান সিয়াম বলেন, জাপানের গ্যাস প্রকল্প সম্প্রসারণের ফলে কার্বন নিঃসরণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। জাপানের এলএনজি সম্প্রসারণের টার্গেট পূরণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করছে। এর মাধ্যমে জাপান আমাদের বিভ্রান্ত করছে।
চলনবিল রক্ষায় আমরা-এর মেহনাজ মালা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলনবিল এর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। কৃষকরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। খরা মৌসুমে মাটির ৫ ফুট নিচে পানি তোলার জন্য মেশিন স্থাপন করতে হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির আগেই পানিতে ফসলের ক্ষেত ভরে যাচ্ছে।
ইউক্যানের যুধিষ্টির চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আমরা যুব সমাজ জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিনিয়োগ চাই না। যুব সমাজ সুস্থ পরিবেশে বেঁচে থাকতে চায়।
সিপিআরডির নূর আতায়া রাব্বি বলেন, বর্তমানে আগের বছরের তুলনায় বেশি কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এর জন্য জাপানের দায়বদ্ধতা আছে, কারণ জাপান এখন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষতিকর প্রকল্পগুলোর অব্যাহত রাখার মাধ্যমে জাপান তার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করছে।
খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ব্লেস্মি বাড়ে বলেন, আদিবাসীরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। প্রকৃতির উপর তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল। প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন হলে তাদের জীবন-জীবিকায় প্রভাব পড়ে।
সমাবেশে শাওন মাইম একাডেমি পরিবেশিত মুকাভিনয়ের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে পরিবেশের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে এবং এর ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকা তুলে ধরা হয়।
সমাবেশে আশা করা হয় জাপান সরকার বাংলাদেশ এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোকে আরও জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে ঠেলে দেওয়া বন্ধ করবে এবং তাদের সংস্থাগুলো তাদের নীতি ও কার্যক্রম পরিবর্তন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তরের দিকে অগ্রসর হবে।
মন্তব্য করুন