মতলব উত্তর (চাঁদপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৬ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ভিক্ষা করে সংসার চালান শহীদ রাজিবের বাবা

আন্দোলনে নিহত রাজিবের মা রাহিমা বেগমের আহাজারি। ইনসেটে শহীদ রাজিব। ছবি : কোলাজ
আন্দোলনে নিহত রাজিবের মা রাহিমা বেগমের আহাজারি। ইনসেটে শহীদ রাজিব। ছবি : কোলাজ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত বছরের ২০ জুলাই গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় মো. আরিফ হোসেন রাজিব (২৬) ভাঙারি দোকানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে গাজীপুর সদর মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত রাজিবের গ্রামের বাড়ি গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামে। রজ্জব প্রধান ও রহিমা বেগম ভিক্ষুক দম্পতির বড় ছেলে রাজিব। পরিবারে দুই ভাই এবং চার বোনের মধ্যে তিন বোন বিবাহিত। রাজিবের স্ত্রী ও ইব্রাহিম নামে চার বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। রাজীব পরিবার নিয়ে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় বসবাস করতেন। সেখানে ভাঙারি ক্রয় করে বিক্রয় করতেন তিনি।

এ ঘটনায় নিহত রাজিবের বাবা রজ্জব আলী বেপারী বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীর আলমসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় গত ২০ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ চলছিল। ওই সময় রাজিব ভাঙারির দোকানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে গাজীপুর সদর মেডিকেলে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেইদিন নিহত রাজিবের স্ত্রী শরীফার কাছে তখন কোনো টাকা ছিল না। স্বামীর লাশ কীভাবে মতলব উত্তরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন, সে চিন্তায় পড়ে গেলেন। পরে বোর্ড বাজার এলাকার লোকজনের সহায়তায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে গ্রামের বাড়ি মতলব উত্তরের গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজে নিয়ে আসেন। ২১ জুলাই তাকে রাঢ়ীকান্দি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নিহত রাজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট্ট একটি ঝুপড়ি বসতঘর তাদের। পাশেই রয়েছে পলিথিন ও কাপড়ের পেঁচানো রান্নাঘর। তার ছোট বোন রান্না করছেন। স্ত্রী শরিফা বেগম শিশু ছেলেকে ঘুম পড়াচ্ছেন আর কান্না করছেন। এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল রাজিবের মা রহিমা বেগমের কান্নার আওয়াজ। ছেলের মৃত্যুতে এখন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন এই মা। ছেলেকে নিয়ে নানাভাবে আহাজারি করতে দেখা গেছে।

রাজিবের বাবা রজ্জব আলী বেপারীর তার ডান হাত অকেজো হয়ে যাওয়ায় ৪ বছর ধরে কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে ভিক্ষা করে সংসার চালান। তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বড় ছেলে রাজীব। রজ্জব আলীর ৪ মেয়ে ২ ছেলে। ৩ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।

সংসারে অভাব থাকায় ছোট মেয়ে সুমি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর লেখাপড়া করতে পারেনি। সে অবিবাহিত। ছোট ছেলে ফয়েজ (১৯) স্থানীয় ওটারচর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ফলে ৬ সদস্যের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ফয়েজ। সে এখন চাঁদপুরের একটি হোটেলে সামান্য বেতনে বয়ের কাজ করে।

শহীদ রাজীবের মা রাহিমা বেগম (৫১) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মৃত্যুর আগের দিন রাতে আমার ছেলেকে মোবাইলে ফোন দিছিলাম। আমার ছেলে কয়, মা আমি যদি মইরা যাই, আমার ছেলেডারে দেইখা রাইখো। অরে এতিম কইরো না। আমি কই, বাজান কী কস। তুই কেন মইরা যাবি। আমার ছেলে কয়, মা হায়াত-মউতের কথা তো কওন যায় না। পরদিন শুনতে পাই আমার জাদুমণি গুলি খাইয়া মইরা গেছে।

কান্নারত অবস্থায় তিনি প্রশ্ন করেন, এহন আমারে কে মা বইল্লা ডাকব? আমার ছোডো পোলাডারে যদি সরকার একখান চারকি দিত, তয় আমাগো সংসার ভালো চলত। তিনি বলেন, কী কমু, আমার স্বামী ভিক্ষা কইরা আমগো সংসার চালায়। দৈনিক ৩-৪ কেজি যা চাউল পায়, তা দিয়াই আমগো সংসার চলে।

রাজীবের স্ত্রী শরীফা বেগম (২৪) বলেন, যারা আমার স্বামীরে মাইরালাইছে, আমি হেগো ফাঁসি চাই। তিনি জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তাদের ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। সে টাকা ব্যাংকে রাজীবের ছেলে ইব্রাহীমের নামে স্থায়ী ডিপোজিট করে রেখেছেন। ইব্রাহীমের বয়স আঠারোর আগে ওই টাকা কেউ উত্তোলন করতে পারবে না। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী দিয়েছে ২ লাখ টাকা। ঢাকা থেকে ছাত্ররা একটি দোচালা ঘর করে দিছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুরের গাছা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন খান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চালাকালীন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরিফুল ইসলাম রাজিব মারা যান। তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করা হয়েছিল। পরে এ ঘটনায় তার বাবা রজ্জব আলী বেপারী বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীর আলমসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মতলব উত্তর থানার ওসি মো. রবিউল হক জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়া রাজিবের লাশ রাঢ়ীকান্দি কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। ফলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন চিফ জুডিশিয়াল আদালত মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেয়। গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে রাজীবের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে লাশ পুনরায় রাঢ়ীকান্দি কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডাকসু নির্বাচন / প্রচারণার প্রথম দিনই শিবিরের ব্যানার ভাঙচুর

হিজাব বিতর্কে ভিকারুননিসার সেই শিক্ষিকা বরখাস্ত

এই ৩ ভুল করছেন? শত চেষ্টাতেও কমবে না মেদ

একদিন পর ভেসে উঠল ইসমাইলের মরদেহ

বিশ্বে প্রথমবার মানব শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই : হাসনাত

ডাকসু নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী ৪৭১

আমি বিবাহিত, ফেসবুকে প্রমাণ করার কিছু নেই : অপু

বাংলাদেশে শুরু হলো দ্বিতীয় আইসিএফপি সম্মেলন

মালয়েশিয়ায় নিবন্ধিত বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রকাশ

১০

ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা নিয়ে সাদিক কায়েমের পোস্ট

১১

বিটিভি চট্টগ্রামের বিশেষ নাটক ‘জিনের বাদশা’

১২

লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাক্ষাৎ

১৩

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৪৭০ জন

১৪

ব্যবসায়ী হত্যার দায়ে দুজনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন

১৫

ড্রেনে গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, কেঁপে উঠল আশপাশের এলাকা

১৬

আমিরকে নিয়ে এশিয়া কাপের জন্য দল ঘোষণা ওমানের

১৭

গাইবান্ধায় কবরস্থান থেকে ৩০টি কঙ্কাল চুরি

১৮

কাতারে জুমার নামাজের সময় দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ

১৯

বরগুনায় অবৈধ ডায়গনস্টিক সেন্টারে অভিযান

২০
X