তিস্তার বুকে ভেসে ওঠা অসংখ্য চর এখন সবুজ বাদামের গালিচায় ঢাকা। মাঠজুড়ে একের পর এক বাদাম ক্ষেত, আর সেই ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষকেরা। কেউ কাঁধে ঝুঁড়ি বেঁধে বাদাম তুলছেন, কেউবা শুকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, থেতরাই, গুনাইগাছ ও বজরা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে এখনই বাদাম তোলার মৌসুম।
এই চরগুলোয় বসবাস করা হাজারও কৃষকের কাছে বাদাম চাষ যেন এক স্বপ্নের নাম। কেউ সেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, কেউ আবার তিস্তার হঠাৎ রুদ্ররূপে চোখের সামনেই দেখেছেন সেই স্বপ্ন ভেসে যেতে।
চরের উঁচু এলাকায় বাদামের বাম্পার ফলন হয়েছে। আলী আকবর নামের এক চাষি জানান, তিনি প্রায় ২ একর জমিতে বাদাম চাষ করেছেন। পরিশ্রম আর পরিকল্পনা মিলে এবার তার আশা ৭০ মণ বাদাম হবে, যা বিক্রি করে লাভ হতে পারে প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
আলীর কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস। তিনি বলেন, এ বছর যদি ভালো দাম পাই, তাহলে ঋণ শোধ করেও কিছু হাতে থাকবে। এই চরের মাটি যেন আবার আশার আলো দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে, নিচু এলাকার চাষিদের চোখে-মুখে হতাশা। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত ডুবে গেছে পানিতে।
গোড়াইপিয়ার চরের কৃষক খোয়াজ মন্ডল দুঃখ করে বলেন, প্রায় দেড় একর জমিতে বাদাম করেছিলাম। কিন্তু পানি এসে সব শেষ। কিছু বাদাম উঠালাম বটে, কিন্তু অনেকটার ভেতর দানা-ই নেই। শুধু খোসা। খরচ উঠে আসবে কি না, তা নিয়েই দুশ্চিন্তা।
তার হিসেবে, জমি থেকে বাদাম তোলা, ঘরে নেওয়া, সব মিলিয়ে খরচ হবে প্রায় ৯০ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন দেখে মনে হচ্ছে, লোকসান হবে নিশ্চিত।
চরবাসীর জীবনের গল্প যেন নদীর মতোই- কখনও শান্ত আবার কখনও ভয়ংকর। যারা উঁচু জমিতে চাষ করেছেন, তারা খুশি। কিন্তু যাদের ক্ষেত নিচু, তাদের মুখে শুধু হতাশার গল্প।
চাষি বকুল মিয়া বলেন, তিস্তার পানি আমাদের জীবন। আবার এই পানিই কখনো কখনো আমাদের সর্বনাশ করে দেয়। তবু আমরা বাঁচি বাদাম ধরে, বাঁচি মাটির গন্ধে।
চাষিরা বলেন, যদি তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতো, তবে আর এভাবে প্রতি বছর ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না।
তিস্তাপারের এই চরগুলো শুধু বালু ও কাঁকর দিয়ে গড়া জমি নয়। এই জমিতে রয়েছে মানুষের স্বপ্ন, শ্রম আর সাহস। বাদাম চাষ যেমন তাদের হাসি এনে দেয়, তেমনি কখনও কখনও চোখের জলও। তবে চাষিরা এখনো স্বপ্ন দেখেন- তিস্তা একদিন শুধু ক্ষতির গল্প বলবে না, বলবে টিকে থাকার, ঘুরে দাঁড়ানোর আর নতুন করে শুরু করার গল্প।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এবার বাদামের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬০ হেক্টর, অর্জিত হয়েছে ৩৬৫ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৩৮ টন। কিছু নিচু এলাকায় বাদাম নষ্ট হলেও উঁচু জমির ফলন খুব ভালো হয়েছে। বাজার ভালো থাকলে কৃষকরা লাভবান হবেন।
মন্তব্য করুন