জুলাই যোদ্ধা সন্তানের অপেক্ষায় এখনো কাঁদছেন বৃদ্ধ মা মেরিনা বেগম। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) তার বুকের ধন সন্তান মনিরুজ্জামান মিলনের নিখোঁজের এক বছর পূর্তি হয়েছে। এক বছর ধরে তিনি ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন। খুঁজে ফিরছেন বিভিন্ন জায়গায়। তার বিশ্বাস ছেলে বেঁচে আছেন। যে কোনো সময় ফিরে এসে ‘মা মা’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরবে।
মা মেরিনা বেগম (৬৫) বুকের ধন মিলনের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছেন। এখনো ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মোবাইল ফোনে ছেলের দরাজ কণ্ঠে মা ডাক শুনতে চান; কিন্তু তার ছেলে আর ফিরে আসে না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকামুখী গণমিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান মিলন। ঢাকার সাভারের আশুলিয়া থেকে রওনা হন তিনি। এর পর আর খোঁজ মেলেনি তার। এক বছরেও মিলনের সন্ধান না মেলায় দুশ্চিন্তায় পরিবার।
মনিরুজ্জামান মিলন সারিয়াকান্দির ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের জোড়াগাছা গ্রামের মৃত সুরুজ্জামানের ছেলে। তিনি আশুলিয়ার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দির গ্রামের বাড়িতে ছিলেন মা, স্ত্রী আর ১১ মাসের কন্যাসন্তান। মিলন নিখোঁজ হওয়ার মাস তিনেক পর চরম আর্থিক সংকটে পড়ে মেয়ে মানসুরাকে নিয়ে বাবার বাড়ি ধুনটের নিমগাছি গ্রামে চলে যান তার স্ত্রী সবিতা বেগম। বৃদ্ধ মা মেরিনা খাতুন এখন একাই থাকেন বাড়িতে।
স্থানীয়রা জানান, নিখোঁজ মনিরুজ্জামান মিলনের বাবা ২০২০ সালের প্রখর রোদে মাঠে কাজ করতে গিয়ে হৃদ্রোগে মারা যান। পরে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন মিলন। তিনি ঢাকা ইপিজেডে ফোর ইয়াং ডায়িং নামে পোশাক তৈরি কারখানার মেকানিক বিভাগে সুপারভাইজার পদে কর্মরত ছিলেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মনিরুজ্জামান মিলনও মিছিলে যোগ দেন। তিনি মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের পানি পান করিয়ে সহায়তা করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিখোঁজ হন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বাড়িসহ সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও মিলনের সন্ধান মেলেনি।
তিনি বলেন, মনে হয় ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, বা তাকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে, বা কোনো গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে শেষ বিদায় জানানোর ভাগ্যও হয়নি তার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা মেরিনা বেগম বলেন, গত ৫ আগস্ট জোহরের আজানের সময় ছেলে মিলনের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। মিলন আমার শরীরের খোঁজ নেওয়ার পর আনন্দ মিছিলে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল; কিন্তু আমি ছেলেকে মিছিল বা কোনো আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম।
কথা বলতে বলতে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে উঠে তিনি আরও বলেন, স্বামীর মৃত্যুর চার বছর পর সংসারের ছেলে মিলনকে হারিয়েছি। এত শোক কীভাবে সহ্য করব। ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস প্রিয় সন্তান মিলন একদিন বাড়ি ফিরে আসবে। আমাকে মা মা বলে ডাকবে।
বড় ভাই শিক্ষক মিল্টন মিয়া বলেন, মিলনের নিখোঁজ সংবাদ পেয়ে গত বছরের ৬ আগস্ট ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেদিন সকালে আশুলিয়া থানার সামনে ফুট ওভারব্রিজের নিচে কাভার্ডভ্যানে ছয়টি লাশ দেখতে পাই। এর মধ্যে ছোট ভাই মিলনের লাশ ছিল না। সারাদিন আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল, থানা ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ করেছি।
তিনি আরও বলেন, সেখানে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে বেশ কিছু টাকা খোয়া গেছে আমার। পরদিন চীন মৈত্রী হাসপাতালসহ আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালে ভাইয়ের খোঁজ করেন। শেষে নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।
মিল্টন বলেন, ভাই মিলনের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে, এমন খবরে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে যাই। সেখানে ১৯টি লাশের মধ্যেও আমার ভাইয়ের লাশ পাইনি। এরপর আমি আবারও প্রতারকদের খপ্পরে পড়ি। তখনও আমার কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। পরে ভাই নিখোঁজের ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করি। এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও মিলনকে পাইনি।
ভাইয়ের ধারণা, হয়তো অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে কোনো গণকবরে জায়গা হয়েছে। যাই হোক না কেন, ভাইয়ের পরিণতি জানতে চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বগুড়ার সদস্য সচিব সাকিব খান বলেন, আমরাও চেষ্টা করছি মিলনকে খুঁজে পাওয়ার; কিন্তু পাচ্ছি না।
বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ বলেন, মিলনের বিষয়টি আমরা জেনেছি। তার বিষয়ে কী করা যায়, তা বিবেচনা করা হচ্ছে। তার পরিবারকে আপাতত কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন