রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ১৬টি পরিবারকে ভয় দেখিয়ে ও টাকা দিয়ে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে সাজ্জাদ আলী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তিনি পাহাড়িয়াদের বলেছেন— ‘যদি থানা-পুলিশে দৌড়াদৌড়ি করো, তাহলে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেটাও দেওয়া হবে না।’
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকালে কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে পাহাড়িয়ারা প্রকাশ্যে এ অভিযোগ করেন।
গত বুধবার ‘শুক্রবার খাসির ভোজ, রোববার ভাঙা হবে ৫৩ বছরের ঘরবাড়ি’ শিরোনামে কালবেলায় প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। সংবাদে উঠে আসে, ৫৩ বছর ধরে ১৬ কাঠা জমিতে পাহাড়িয়া পরিবারগুলো বসবাস করছে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে সাজ্জাদ আলী জমির মালিকানা দাবি করেন। তার চাপে এরই মধ্যে ৩টি পরিবার জায়গা ছেড়ে গেছে।
সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসন তৎপর হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ওসি আজিজুল বারী পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় পাহাড়িয়ারা জানান, সাজ্জাদের হুমকির কারণে তারা থানায় যেতে পারেননি। এক নারী বলেন, ‘সাজ্জাদ আলী বলেছেন— যদি বাড়াবাড়ি করি, তাহলে টাকাও দেবেন না। তাই বাধ্য হয়ে টাকা নিতে হয়েছে।’
আরেকজন বলেন, ‘আমরা জন্ম থেকে এখানে আছি। জন্মভূমি ছেড়ে যেতে চাই না। কিন্তু ভয় দেখিয়ে আমাদের টাকা নিতে বাধ্য করা হয়েছে।’
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আসাদ আলী পুলিশের সামনে বলেন, ‘এখানে ওরা ৬২ বছর ধরে বাস করছে। আসল মালিক ছিলেন ইন্দ্রা ধোপা। সাজ্জাদের কথা আমরা শুনিনি।’
পুলিশ যাওয়ার পর সাজ্জাদ আলী দলিল হাতে ঘটনাস্থলে যান। তিনি দাবি করেন, ১৯৯৪ সালে মধুসূদন দাস, দিলীপ দাসসহ কয়েকজনের কাছ থেকে জমি কিনেছেন। তার ভাষ্য, ‘তারা এতদিন এখানে ছিল, এখন যাচ্ছে। আমি তাদের মুরগি খাওয়াতে চেয়েছিলাম, তারাই খাসি খাওয়ার কথা বলেছে।’ তবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুক্রবার কোনো খাওয়ানো বা খাসি জবাই হবে না।
জমির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন : ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, হড়গ্রাম মৌজার ১২৯০ দাগের ৩৭ দশমিক ৯৪ শতক জমির মালিক হিসেবে আরএস খতিয়ানে গাজিয়া রজকিনি ও মনিতারা রজকিনির নাম রয়েছে। তবে ১৯৯৪-৯৫ সালে এ জমি খারিজ হয় সাজ্জাদ আলীসহ আরও কয়েকজনের নামে।
ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান, সাজ্জাদ আলীর দলিল প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, যাদের কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে বলে দাবি, তাদের নামে জমি কীভাবে হয়েছিল— তার কোনো দলিল পাওয়া যাচ্ছে না। সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত প্রয়োজন।
তদন্তে প্রশাসন ও মানবাধিকার সংগঠন : এ ঘটনায় পাহাড়িয়াদের মহল্লা পরিদর্শন করেছেন জুলাই-৩৬ পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি গণেশ মার্ডি, মানবাধিকারকর্মী আরিফ ইথারসহ অনেকে।
গণেশ মার্ডি বলেন, ‘আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। চুপিসারে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।’ মাহমুদ জামাল কাদেরীর মন্তব্য, ‘৫৩ বছর ধরে এখানে মানুষ বসবাস করছে। অথচ আরএস রেকর্ডে দখলীয় হিসেবেও তাদের নাম নেই— এটি বড় প্রশ্ন।’
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল ইসলাম কালবেলাকে জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তদন্ত চলছে। সার্ভেয়ার পাঠানো হয়েছে, তিনিও সরেজমিন গিয়ে প্রতিবেদন দেবেন।
বাড়িঘর ছাড়ার শর্ত ও টাকার অঙ্ক : অভিযোগ রয়েছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সাজ্জাদ আলী অল্প টাকার বিনিময়ে জমি দখল করছেন। প্রথমে ছয়টি পরিবারের প্রতিটি বাড়িকে দেওয়া হয় ৬ লাখ টাকা। তিন প্রজন্মে তা বেড়ে ১৬ পরিবারে ভাগ হয় মোট ৩০ লাখ টাকা। ফলে কেউ পেয়েছেন ৫০ হাজার, কেউ ১ লাখ, কেউবা ২ লাখ টাকা। এর মধ্যেই তিন পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। বাকিদের রোববারের মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছিল।
মোল্লাপাড়ার এ জমি এখন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে, আমচত্বর-কাশিয়াডাঙ্গা সড়ক সংলগ্ন। জমির বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন