বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ ভাদ্র ১৪৩২
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শুক্রবার খাসির ভোজ, রোববার ভাঙা হবে ৫৩ বছরের ঘরবাড়ি

বাড়ির আঙিনায় আদিবাসী বৃদ্ধা। ছবি : কালবেলা
বাড়ির আঙিনায় আদিবাসী বৃদ্ধা। ছবি : কালবেলা

রাজশাহীর মোল্লাপাড়ার ছোট্ট এক টুকরো পাড়া— সবাই যার নাম দিয়েছে ‘আদিবাসীপাড়া’। এখানে তিন প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছেন পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। ৫৩ বছরের শিকড় গেড়ে থাকা সেই আবাস আজ ভেঙে যাচ্ছে।

আগামী শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) সাজ্জাদ আলীর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হবে খাসির ভোজ। সেদিন সবাইকে খাওয়ানো হবে ভরপেট। কিন্তু আনন্দের সেই ভোজ আসলে বিদায়ের ঘণ্টা। কারণ পরের রোববারের (৭ সেপ্টেম্বর) মধ্যেই তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে হবে।

অর্ধশতাব্দীর বসতি এখন উচ্ছেদের মুখে : জানা গেছে, ৫৩ বছর আগে ১৬ কাঠা জমির ওপর ছয়টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। ইন্দ্র ধুপি নামের এক দয়ালু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের জায়গা দিয়েছিলেন মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে। সময়ের সঙ্গে ছয়টি বাড়ি বেড়ে দাঁড়ায় ১৬টিতে। এই ছোট্ট মহল্লাই হয়ে ওঠে তাদের শেকড়, সংস্কৃতি আর স্মৃতির ভাণ্ডর।

কিন্তু এখন জমির মালিকানা দাবি করছেন সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি। তিনি দাবি করেন, ইন্দ্র ধুপি মৃত্যুর আগে জমি বিক্রি করে গিয়েছিলেন তার কাছে। স্থানীয়রা জানান, সাজ্জাদের দখলের চাপে ইতোমধ্যে তিনটি পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছে। এখনো বাকি রয়েছে ১৩টি পরিবার— যাদের আগামী রোববারের মধ্যে বিদায় নিতে হবে।

ন্যায্যতার প্রশ্ন : পাড়ার বাসিন্দা মিশ্র রাম বর্মণ (৪০) জানান, বছর দুয়েক আগে বিষয়টি নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের সামনে বসা হয়েছিল। তখন সাজ্জাদের দলিলকে জাল বলেছিলেন কাউন্সিলর। কিন্তু সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। পরে আর কোনো উদ্যোগ হয়নি।

গত বছরের ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর, ফের হাজির হন সাজ্জাদ। তখন তিনি বাড়ি ছাড়তে বলেন। প্রথমে কিছু টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন, পরে সেই টাকাই নির্ধারিত হয় বাড়ি ছাড়ার শর্ত হিসেবে। ছয়টি মূল পরিবারের প্রতিটি ঘরের জন্য নির্ধারণ করা হয় মাত্র ৬ লাখ টাকা।

মিশ্র রাম বলেন, ‘আমরা তো কারও কাছে যেতে পারছি না। কাউন্সিলরও নাই। তাই বাধ্য হয়েই রাজি হলাম। এখন বাড়িতে তিন ছেলে থাকলে দুই লাখ করে ভাগ হবে। এই সামান্য টাকা নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে।’

ভাঙনের বেদনা : এ পাড়ার প্রবীণতম বাসিন্দা ফুলমনি বিশ্বাসের বয়স এখন প্রায় ৮০। প্রথম দিকের ছয় পরিবারের একজন তিনি। বাড়ির সামনে বসে বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কোথায় যাব? আমরা তো এখুন আন্ধার ঘরে হাইতড়াই তো পাছি ন্যা। আমরাও কিছু খুইজে পাছি ন্যা।’

তার মেয়ে সরলা বিশ্বাসের জন্মও এই মহল্লায়। ‘এখানেই জন্ম, এখানেই বড় হয়েছি। এখন সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। অন্যায় মনে হয়, কিন্তু করার কিছু নাই।’

ইতোমধ্যে তিন পরিবার ঘর ভেঙে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বাকিরা গুছিয়ে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কেউ কেউ গ্রামে সামান্য জমি কিনেছেন, কিন্তু বাড়ি করার মতো অর্থ নেই কারও হাতে।

গর্ভবতী পার্বতী রানীর চোখে শুধু উৎকণ্ঠা। ‘আমি পোয়াতি। এখন কার বাড়িতে গিয়ে উঠব?’ কথাগুলো বলার সময় তার চোখে ভয় আর অনিশ্চয়তার ছাপ।

তরুণ শিপেন বিশ্বাস, সদ্য এইচএসসি পরীক্ষার্থী, জানালেন তার দাদা বামনা পাহাড়িয়া ছিলেন প্রথম ছয়জনের একজন। এখানেই তার বাবা জন্মেছেন, সেও জন্মেছে। অথচ রোববারের পর আর থাকবে না তাদের পরিচিত সেই ভিটেমাটি।

সাজ্জাদের দাবি : অন্যদিকে সাজ্জাদ আলী বলছেন, ‘জমিটা আমার কেনা। কয়েকটা ঘর আগেই ছিল। আমি জোর করে উচ্ছেদ করছি না, সুন্দরভাবে বিদায় দিচ্ছি। টাকা দিয়ে দিয়েছি, তারা বাড়িঘর করছে। শুক্রবার খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেছি, তারপর রোববার তারা চলে যাবে।’

তবে কবে জমি কিনেছেন, তা মনে নেই বলেই জানান তিনি। সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম তার দলিলকে জাল বলেছিলেন কি না— জানতে চাইলে সাজ্জাদের উত্তর, ‘এটা মিথ্যা কথা।’

প্রশাসনের নীরবতা : সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী বলেন, তার জানা নেই এমন কোনো বিষয়। তবে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ হলে পাহাড়িয়া পরিবারগুলো থানায় আসতে পারে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক টুকরো প্রশ্নবিদ্ধ বিদায় : অর্ধশতাব্দী ধরে টিকে থাকা একটি সম্প্রদায়, তাদের শিকড়, স্মৃতি, জন্ম ও মৃত্যুর গল্প— সবকিছু ভেঙে যাচ্ছে টাকার বিনিময়ে। শুক্রবারের ভোজ হয়তো ভরপেট খাওয়াবে, কিন্তু রোববারের পর সেসব পরিবার কোথায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পাবে, তার উত্তর কারও কাছে নেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সরাসরি বিমান চলাচল পুনঃস্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ফলপ্রসূ মতবিনিময়

রাজকীয় আসনে বসে শহর ঘুরলেন ‘ক্ষুদে খালেদা জিয়া’

অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে এককাট্টা ইউরোপের ৩ দেশ

সুস্থতা নিশ্চিতে প্রয়োজন সঠিক জীবনযাপন ও খাদ্যাভাস পরিবর্তন

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফ্রান্স রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

বিশ্ব দূরপাল্লার সাঁতারে বাংলাদেশের ৬ পদক

জলদস্যুদের গুলিতে আহত জেলের মৃত্যু

ওয়ার্ল্ড আরচারির সম্মাননা পেলেন চপল

আর কোনো বাঁধাই নির্বাচনী ট্রেন থামাতে পারবে না : বাচ্চু

তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশ হবে বিশ্বের রোল মডেল : বিপ্লব

১০

নড়াইলে শুরু হতে যাচ্ছে কিউট জেলা হ্যান্ডবল লিগ

১১

নদীপাড়ের মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণ, বাধা দেওয়ায় প্রশাসককে হুমকি

১২

গাজীপুরে ডোবায় পড়ে দুই শিশুর মৃত্যু

১৩

পুঁজিবাজারে বড় কোম্পানি আনার সিদ্ধান্তে ডিবিএর অভিনন্দন

১৪

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের শত্রু : জুয়েল

১৫

স্টুডেন্ট স্কয়ার ফাউন্ডেশনের গ্রুপ কাউন্সেলিং সেশন অনুষ্ঠিত

১৬

বিএনপির হাতেই এ দেশ নিরাপদ : ফয়সল চৌধুরী

১৭

সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে : উপদেষ্টা শারমীন  

১৮

আর্জেন্টিনায় মেসির শেষ ম্যাচ নিয়ে যা বললেন স্কালোনি

১৯

পাকিস্তানকে বিশেষ প্রতিশ্রুতি দিলেন পুতিন

২০
X