গত দুই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে খুলনার অতি গুরুত্বপূর্ণ শিপইয়ার্ডের সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ। এরই মধ্যে এক বছরের কাজ সাড়ে তিন বছরেও শেষ করতে না পারায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চুক্তি বাতিলের পর জব্দ করা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জামানতের সাত কোটি টাকা।
তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও ৬০ কোটি টাকা দাবি করেছে মাহাবুব ব্রাদার্স নামে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আওয়ামীপন্থি প্রভাবশালী এ ঠিকাদারের পক্ষে এখন খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) কার্যালয়ে সশরীরে গিয়ে নিয়মিত তদবির করছেন খুলনা একাধিক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা।
ফলে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে সহস্রাধিক ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে অতিগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি। এ নিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)সহ একাধিক সামাজিক সংগঠনের অব্যাহত আন্দোলনেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে খুলনার আলোচিত এ সড়কটিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনা অফিস। খুলনা অফিসের উপপরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে সড়কটির রূপসা সেতু এলাকায় ৩০০ মিটার এলাকা পরীক্ষা করা হয়। থার্ডপার্টি (নিরপেক্ষ) প্রকৌশলীর মাধ্যমে চালানো ওই পরীক্ষায় মেজারমেন্ট বুকে থাকা কাজ শেষ হওয়া অংশের মধ্যে সরেজমিন ব্যাপক অনিয়ম খুজে পেয়েছে দুদক।
সরেজমিন ওই পরীক্ষায় দেখা যায়, তিনশ মিটারের মধ্যে নিচে ১০ ইঞ্চি বালির লেয়ার এবং এর উপরে ১০ ইঞ্চি সাব বেইজ থাকার কথা (৭০ শতাংশ খোয়া এবং ৩০ শতাংশ বালি) কিন্তু দুদকের প্রকৌশলী বাস্তবে এমন কিছুই পায়নি। মেজারমেন্ট বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩ হাজার ৬৭৬ মিটার দৈর্ঘ্য সড়কের পুরোটাতেই কাজ করা হয়েছে।
দুদক খুলনা অফিসের উপপরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কে আমরা বিশেষজ্ঞ নিয়ে অভিযান চালিয়েছি। কেডিএ থেকে পাঠানো এ সড়কের মেজারমেন্ট বইতে ৩ হাজার ৬৭৬ মিটার সড়কের পুরোটাই কাজ হয়েছে। তবে আমরা রূপসা সেতুসংলগ্ন এলাকায় মাত্র ৩০০ মিটার এলাকা পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু মেজারমেন্ট বইয়ের সাথে এখানে ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা দুইটি লেয়ারে বালি এবং বালি খোয়া মিক্সড যে দুটি লেয়ার ছিল তার কোনো অস্তিত্ব পাইনি। কিন্তু পুরো সড়ক পরীক্ষা করে না দেখতে পারারা কারণে কীভাবে কী দুর্নীতি হয়েছে আমরা এখনও সেভাবে বলতে পারছি না। আমাদের পুরো অভিযানটি শেষ হলে আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে পারব।
এদিকে খুলনার ভাঙাচোরা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প নিয়ে জটিলতা এক যুগেও কাটেনি। ওই প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না করা, মাঝপথে ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে। এ কারণে গত ৭ আগস্ট তাদের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। সড়কটির বাকি কাজ শেষ করতে সংস্থাটি গত ২৪ আগস্ট নতুন করে দরপত্র আহ্বান করেছে। এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাহাবুব ব্রাদার্স।
নতুন দরপত্রের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে সম্প্রতি আদালতে মামলা ও ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে আরবিট্রেটর নিয়োগ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে নিরাপত্তা জামানত বাজেয়াপ্ত করার আদেশের বিরুদ্ধেও তারা আদালতের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেছিল। আদালত ওই টাকা কেডিএর অনুকূলে হস্তান্তর না করতে ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন থেকেই সড়কটি ভাঙাচোরা। মেরামতের কিছুদিন পরই সড়কে গর্ত তৈরি হতো। ২০১৩ সালের ৭ মে ওই সড়ক চার লেনে উন্নীত করে পুনর্নির্মাণের জন্য একনেকে পাঠানো কেডিএর প্রকল্প অনুমোদন পায়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্প সংশোধন করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৯ কোটি টাকায়।
২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি কেডিএ ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আতাউর রহমান লিমিটেড অ্যান্ড মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে (জয়েন্ট ভেঞ্চার)। ১৫৫ কোটি টাকা খরচে তাদের ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করে পুনর্নির্মাণ, দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত, সড়কের মাঝে দশমিক ৯২ মিটার ডিভাইডার নির্মাণ, লবণচরায় ৬৬ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ; মতিয়াখালীতে স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল।
ওই বছরের ২০ জানুয়ারি কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ের এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও অর্ধেক কাজ শেষ হয়নি।
গত সাড়ে ৩ বছরে বিগত সরকারের পূর্তমন্ত্রী, সচিব, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা খুলনায় এসে দ্রুত কাজ শেষ করতে ঠিকাদারকে নির্দেশ দিয়েছেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কালো তালিকাভুক্ত করারও। তারপরও কাজে গতি আনেননি ঠিকাদার।
প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, গত সাড়ে ৩ বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৭০ কোটি টাকা তুলেছে। অনেক কাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে সড়কের বেজ টাইপ-২ (বর্তমান সড়কের ওপর পাথরের স্তর), বেজ টাইপ-১, ৪ ইঞ্চি বিটুমিনের কার্পেটিং (পিচের স্তর), তার ওপর সিলকোর্ট (বিটুমিনের আরেকটি স্তর) দেওয়া বাকি রয়েছে। ৬৬ মিটার দীর্ঘ লবণচরা সেতুর ১০টি গার্ডারের মধ্যে মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে, ৯টিই বাকি। মতিয়াখালীতে দুই স্তরের স্লুইসগেটের মধ্যে এক স্তর শেষ হয়েছে।
এ বিষয়ে কেডিএর কয়েকজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদার স্বেচ্ছায় যোগাযোগ না করলে তারাও কিছু পারেন না।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, এই সড়কের পাশে ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২৭টি চালকল, ২৫০টি কাঠের চেরাইকল ও বান্দাবাজারে ৪৫০টির বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নাজুক সড়কের কারণে তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। সড়কটি ব্যবহার করে কেসিসির ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষাধিক বাসিন্দা প্রতিদিন কষ্ট করে যাতায়াত করেন।
খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মো. আরমান হোসেনের দাবি, ওই সড়কের ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন কাজ। মেজারমেন্ট বুকে আছে যে কাজ সে কাজ হয়েছে আমরা তথ্য প্রমাণ সহকারে জমা দেব। সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কের সামনের তিন কিলোমিটার ঠিক আছে কিন্তু বৃহস্পতিবার যখন পরীক্ষা করা হয়েছে তখন বর্ষার কারণে কাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামনে ঠিক আছে।
দুদক বলেছে কেডিএ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে এমন হয়েছে এ বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, তারা কী বলেছে জানি না। এটি একটি চলমান কাজ, যা এখনও শেষ হয়নি। যেখানে কাজ বাকি আছে সেখানে তা করা হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাকভাবে কাজ না করায় আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছি। নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আশা করি, দ্রুত একটি সমাধান হবে।
এসব অভিযোগ নিয়ে মাহাবুব ব্রাদার্সের পক্ষে কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। এমনকি খুলনার দৌলতপুরে তাদের অফিসও তালাবদ্ধ।
মন্তব্য করুন