বেতন বৃদ্ধি ও ভাতা দেওয়াসহ একাধিক দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে শুরু হওয়া অনির্দিষ্টকালের বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় মালিক ও শ্রমিক পক্ষের দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে সমঝোতা হওয়ায় মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নাটোর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটগামী বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়।
টানা ষষ্ঠ দিনের মতো রাজশাহী থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল না করায় সাধারণ যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের এই আন্দোলনে হঠাৎ বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজারো মানুষ বিকল্প পরিবহনের খোঁজে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল।
এর আগে তিন দফায় রাজশাহী থেকে ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন থেকে এভাবে একের পর এক ইস্যু দাঁড় করিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন।
তবে মঙ্গলবার বিকেলে মালিকপক্ষ বাসের সুপারভাইজারের ভাড়া নতুন করে ১০০ টাকা এবং সহযোগির ভাড়া ৫০ টাকা বৃদ্ধির আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার হলে ভোগান্তির আপাতত অবসান হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকার গাবতলীতে মালিক-শ্রমিক বৈঠকে একটি সমঝোতা হয়। সেখানে ওদিন বিকেল ৪টা থেকে বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় মালিক-শ্রমিকরা। কিন্তু ওইদিন বিকেল ৪টার আগ মুহূর্তে কয়েকজন শ্রমিক এসে বাস কাউন্টারগুলোতে মীমাংসা বৈঠকের রেজুলেশনের ফটোকপি টাঙ্গিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন। একপর্যায়ে তারা ঘোষণা দেন, এই দাবি মানা না হলে রাজশাহী থেকে দূরপাল্লার কোন গাড়ির চাকা ঘুরবে না।
এমন নতুন দাবিতে সোমবার রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত শ্রমিকদের একাংশ শিরোইল টার্মিনালে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে সড়কে বসে প্রতিবাদ করেন। তাদের দাবি—ঢাকা-রাজশাহী রুটে প্রতিটি গাড়ির জন্য তিনটি করে ফ্রি টিকিট দিতে হবে। এ দাবি না মানা পর্যন্ত তারা গাড়ি চলতে দেবেন না।
মঙ্গলবার সকাল তারা দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রেখে আবারও আন্দোলন শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা মঙ্গলবার বিকেলে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় বসে। আলোচনায় উভয়পক্ষের সমঝোতায় বিকেল ৫টা থেকে পুনরায় বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা। দুই দিন পর মালিকপক্ষের আশ্বাসে বাস চালু হলেও, প্রত্যাশিত বেতন-ভাতা না পাওয়ায় ২২ সেপ্টেম্বর ফের কর্মবিরতি শুরু করেন তারা। ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একতা ট্রান্সপোর্ট ছাড়া অন্য কোনো দূরপাল্লার বাস চলেনি। পরে বেতন বাড়ানো হলেও শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব নিরসন হয়নি। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে শ্রমিকরা খোরাকি ভাতার টাকা নিয়ে ঢাকাগামী বাস কাউন্টারের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে শ্রমিকদের বাগবিতণ্ডা হয়। এর জের ধরেই ওই রাত থেকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত বাস চলাচল বন্ধ ছিল।
এদিকে গত ৫ দিন ধরে রাজশাহী থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তির যেন সীমা ছিল না। সরেজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার ভোরে রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনালে প্রথমে কাউন্টারগুলো খোলা থাকলেও পরে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভোরে দুটি বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও সকাল ৮টার বাস ছাড়তে গেলে শ্রমিকরা বাধা দেন। এ সময় যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয় এবং টিকিটও বাতিল করা হয়। হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত শত শত যাত্রীকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের যাত্রী রুবেল হোসেন বলেন, ‘পরিবার নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছি। কিন্তু হঠাৎ বাস থেকে নামিয়ে দিলো। ছোট বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্ট কেউ বোঝে না।’
ঢাকায় চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন নাটোরের গৃহবধূ সেলিনা বেগম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রোগীর অবস্থা গুরুতর। এখন গাড়ি নেই, কী করব? ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের জীবন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে।’
শুধু তারা নন, সকাল থেকে শত শত যাত্রী টার্মিনালে আটকা পড়ে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। কেউ কেউ বিকল্প যানবাহনে ঢাকায় রওনা দিলেও অতিরিক্ত ভাড়া ও সীমিত আসনের কারণে সেই যাত্রা হয়ে উঠেছিল আরও কষ্টসাধ্য।
বাস ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরবঙ্গ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব নজরুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘এর আগে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চালক পাবেন ১ হাজার ৭৫০ টাকা, সুপারভাইজার ৭৫০ টাকা ও হেলপার ৬৫০ টাকা। ঢাকা-কানসাট রুটে চালক পাবেন ১ হাজার ৯৫ টাকা, সুপারভাইজার ৮০০ টাকা ও হেলপার ৭০০ টাকা। পাশাপাশি খাবার খরচও ২১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের একাংশের ফ্রি টিকিটের দাবি মেনে না নেওয়ায় আবারও জট তৈরি হয়। পরে মঙ্গলবার আবার হেলপারের ৫০ টাক বাড়িয়ে ৭৫০ এবং সুপারভাইজারের ১০০টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করা হয়। পরে শ্রমিকরা বাস চলাচলে সম্মত হলে বিকাল থেকে বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়।’
মন্তব্য করুন