টঙ্গীতে অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করেছেন প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট ও মৈত্রী শিল্পের চাকরিচ্যুত কর্মী ও শ্রমিকরা। মঙ্গলবার (০৭ অক্টোবর) বিকেলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে এ ঘটনা ঘটে।
পরে উপদেষ্টা নিজেই তাদের অভিযোগ শোনেন এবং তদন্তের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এর আগে দিনব্যাপী উপদেষ্টা গাজীপুরের টঙ্গীতে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট ও মৈত্রী শিল্প কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে প্রতিবন্ধী কর্মীদের হাতে তৈরি মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার, প্লাস্টিক সামগ্রী এবং বিভিন্ন উৎপাদন ইউনিট ঘুরে দেখেন। উৎপাদন মান, কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা এবং কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
পরিদর্শন শেষে মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, ‘মুক্তা পানি বাণিজ্যিকভাবে উন্নত মানে উৎপাদন নিশ্চিত করতে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এ ব্র্যান্ডকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। মৈত্রী শিল্পকে আরও সুশৃঙ্খলভাবে ও টেকসইভাবে এগিয়ে নিতে ধারাবাহিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি যদিও ইঞ্জিনিয়ার নই, তবে কাজের মান ও গুণগত দিকের প্রতি আমার বিশেষ মনোযোগ থাকবে। কাজের কোয়ালিটি নিশ্চিত করাই হবে আমার মূল ফোকাস।’
এ সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ এবং মৈত্রী শিল্পের নির্বাহী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমান,ও ম্যানেজার মহসিন উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শন শেষে উপদেষ্টা বের হওয়ার সময় প্রধান ফটকে বেশ কয়েকজন চাকরিচ্যুত প্রতিবন্ধী শ্রমিক ও কর্মচারী তার গাড়ি অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
তারা অভিযোগ করেন, ২০১৪ সাল থেকে চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে অসংখ্য প্রতিবন্ধী কর্মীকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অথচ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনও বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন।
চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা উপদেষ্টার হাতে একটি লিখিত স্মারকলিপিও তুলে দেন, যেখানে তারা উল্লেখ করেন— প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট ও মৈত্রী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর্মীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করছে এবং প্রকৃত প্রতিবন্ধী কর্মীদের বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করে ব্যক্তিগত লাভবান হচ্ছেন।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা জীবিকার তাগিদে সরকারের নিকট পুনর্বহাল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবি জানাচ্ছেন।
চাকরিচ্যুতএ শারীরিক প্রতিবন্ধী ইমরান বলেন, ‘আমরা যারা প্রকৃত প্রতিবন্ধী, আমাদের চাকরি ছিল জীবনের আশ্রয়স্থল। অথচ আমাদের অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই ঋণগ্রস্ত ও অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।’
বিক্ষোভের সময় উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি মনোযোগ সহকারে অভিযোগ শুনে বলেন, ‘আমি আপনাদের অভিযোগ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করব। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হবে। কেউ অন্যায় করলে ছাড় দেওয়া হবে না।’
তার এই আশ্বাসের পর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা শান্ত হন এবং অবরোধ তুলে নেন। উপদেষ্টার মানবিক আচরণের ফলে উত্তেজনা প্রশমিত হয় বলে জানিয়েছেন উপস্থিত কর্মকর্তারা।
চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আরও দাবি জানানো হয় যে, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতি চলছে। প্রকৃত প্রতিবন্ধী কর্মীদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তারা সরকারের কাছে তিনটি প্রধান দাবি জানান— অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের দ্রুত পুনর্বহাল, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপসারণ ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করতে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন।
প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কিছু প্রক্রিয়াগত কারণে কিছু কর্মীর চাকরি স্থগিত হয়েছিল। তবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন এবং দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি প্রাথমিক তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
এই ঘটনাকে প্রশাসনিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদের সরাসরি মাঠপর্যায়ে এসে চাকরিচ্যুত প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের কথা শোনা— একটি মানবিক ও ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে সমাজে প্রশংসিত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন