

রাজশাহীর শীত একসময় ছিল অতিথি পাখির হাঁকডাকে মুখর। পদ্মার ব-দ্বীপ, চরভূমি আর বিস্তীর্ণ জলাধার ভরে উঠত হাজারো জলচর পাখিতে। কিন্তু সেই পরিচিত দৃশ্য যেন ক্রমেই স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে। চলতি শীতে রাজশাহীতে পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি এক দশকের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে— চিন্তায় ফেলেছে গবেষক ও পাখি পর্যবেক্ষকদের।
তাদের মতে, আবাসস্থল ধ্বংস, মানুষের অতিমাত্রায় বিরক্ত করা এবং শহরের রাতের আলোর ঝলকানি মিলিয়ে গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা।
ডিসেম্বরের শুরুতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে স্থানীয় পাখি পর্যবেক্ষকরা পদ্মার বিভিন্ন পয়েন্টে যে চিত্র দেখেছেন— তা আগের দশকের বাস্তবতার সম্পূর্ণ উল্টো। যেসব চরে হাজার হাজার হাঁস ও জলচর পাখির বিচরণ চোখে পড়ত, সেখানে এখন দেখা যায় বিচ্ছিন্ন কিছু ছোট দল মাত্র।
পদ্মার তীরে ১৪ বছর ধরে নিয়মিত পাখি পর্যবেক্ষণ করে আসা হাসনাত রনি বলেন, ‘২০১০ সালের তুলনায় এখন পদ্মার চর এলাকায় পাখির সংখ্যা এক-দশমাংশও নেই। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টা ছিল পুরো পদ্মাজুড়ে পাখির মৌসুম। এখন ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও পাখি খুব কম দেখা যায়।’
২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের চার বিভাগে পরিচালিত এক গবেষণা জানায়, দেশের মোট জলচর অতিথি পাখির ৪০ শতাংশই রয়েছে রাজশাহীতে। সিলেটে ২৯ শতাংশ, রংপুরে ১৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ১৪ শতাংশ। গবেষণায় যে ৩৬৭টি জলচর অতিথি পাখি শনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে রাজশাহীতেই পাওয়া গেছে ১৫৭টি। গবেষকদের মতে, পদ্মা নদীর জলাভূমি আবাসস্থলের ক্রমাগত অবনতি— বিশেষ করে চরভূমি, কাদামাটিযুক্ত সমতল ভূমি এবং বাসা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এ প্রজাতিগুলো এখন বড় ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে।
গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে পরিত্যক্ত প্রজনন ক্ষেত্রগুলোর ৬৬ শতাংশই সরাসরি আবাসস্থল ধ্বংস ও মানুষের উপদ্রবের কারণে বিলীন হয়েছে। রাজশাহীর নদী তীরবর্তী এলাকার দৃশ্যপটেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজশাহী শহরের রাতের অতিরিক্ত আলোকায়ন পাখিদের ন্যাভিগেশন বা পথনির্দেশ ব্যাহত করছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে শহরজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে কল্পনা হল মোড় থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার সড়কে বসানো হয়েছে ১৩০টি সুসজ্জিত খুঁটি, যার প্রতিটিতে রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী ১৩টি করে এলইডি বাতি।
পাশাপাশি সড়কের ধার ঘেঁষে বসানো হয়েছে আরও ১৮০টি সড়কবাতি, প্রতিটিতে রয়েছে পাঁচটি করে ঊর্ধ্বমুখী এলইডি লাইট। ওপরে মুখ করা এসব লাইট পুরো পদ্মা তীরকে রাতভর আলোকিত রাখে।
হাসনাত রনি বলেন, ‘অতিথি পাখি রাতের অন্ধকারকে পথনির্দেশ হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু আকাশ আলোয় ভরে গেলে তারা দিক হারিয়ে ফেলে, বিভ্রান্ত হয় এবং রাজশাহীকে এড়িয়ে চলে। সময় নিয়ন্ত্রণ ও ন্যাভিগেশন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে অনেক পাখি ভোর হওয়ার আগেই দিক বদলে অন্যত্র চলে যায়।’
তিনি জানান, মোটরসাইকেলের শব্দ, পর্যটকের ভিড়, নৌকার চলাচল এবং অবৈধ শিকার— সবকিছু মিলেই পাখির খাদ্য ও বিশ্রামস্থল কমে যাচ্ছে। ভারতের সীমানার ওপারের চরভূমি তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ায় অনেক প্রজাতি এখন বাংলাদেশের অংশ এড়িয়ে সেখানে বসছে। যদিও অতীতের তুলনায় বড় আকারের শিকার এখন অনেকটাই কমে গেছে, তবুও নির্জন চরাঞ্চলে রাতের বেলায় অবৈধ শিকার এখনো পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন অতিথি পাখির কোনো জাতীয় পর্যায়ের গণনা না থাকার ফলে সুরক্ষা পরিকল্পনাও অগোছালো রয়ে গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা বলেন, ‘চরাঞ্চলে পাখির আবাসস্থল দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। এলাকার শত শত খাল-বিল এখন বাণিজ্যিক মাছের ঘেরে রূপান্তরিত হওয়ায় পাখির বিচরণস্থল হারিয়ে গেছে। রাবিতেই আগে যেখানে ডজনখানেক পুকুর ছিল, এখন অতিথি পাখির জন্য খোলা আছে মাত্র একটি।’
তিনি মনে করেন, পাখির সংখ্যা কমে গেলে বাস্তুসংস্থানে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে— ফসলি জমিতে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ কমে যায়, বীজ বিস্তার ও পরাগায়ন ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে কৃষিতেও।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি সময়টাই অতিথি পাখির বিচরণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা আশঙ্কা করছেন, পাখি কমার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে অনেক প্রজাতি রাজশাহী পুরোপুরিই এড়িয়ে যেতে পারে।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, আবাসস্থল হ্রাস ও মানুষের বিরক্তি অতিথি পাখির আগমনের ওপর প্রভাব ফেলছে। তবে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া পাখি কমার হার সঠিকভাবে বলা কঠিন।
তিনি জানান, অতিথি পাখির আবাসস্থল রক্ষা, শিকার রোধ ও যাতে তাদের বিরক্ত না করা হয়— সেসব লক্ষ্য নিয়ে তারা চরাঞ্চলে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, লিফলেট বিতরণ এবং শীতকালে নিয়মিত টহল জোরদার করছেন। পাশাপাশি পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
মন্তব্য করুন