নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাজুড়ে যেন ইটভাটার রাজ্য। সবজির ভান্ডারখ্যাত এ উপজেলা এখন যেন ইটভাটায় ঘেরা। এ উপজেলায় ১ শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪টির বৈধতা রয়েছে। গত প্রায় দুই যুগ ধরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার কারণে সেখানে আর আগের মতো ফসল হয় না। এখানকার ফসলের মাটি গিলে খাচ্ছে ইটভাটাগুলো। এতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসন নির্বিকার।
সরেজমিন দাউদপুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। নদ-নদীর তীর যেদিকে চোখ যায়, শুধুই সারি সারি ইটের ভাটা। স্থানীয় নুরুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দেবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজীরবাগ মাদ্রাসা ও খাস কামালকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের বাড়িঘর ঘেঁষেও রয়েছে ইটভাটা। সেখানকার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আর বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষিজমি। শুধু দাইদপুর ইউনিয়ন নয়। রূপগঞ্জের ভোলাব ইউনিয়ন, গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন, ভুলতা ইউনিয়ন ও তারাব পৌরসভায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা।
সরেজমিনে কাঞ্চন পৌরসভার বিরাব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পাশে ফসলের মাঠজুড়ে নদীর জায়গা দখল করে কেবিএম ব্রিকস ও পাশেই এআরই ব্রিকস নামের ইটভাটা বিআইডব্লিউটিএ জায়গা দখল করে তৈরি করছেন ইট এবং ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরির কাজ চলছে রীতিমতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব পোড়ানো হয় সেখানে। এতে বাতাস দূষিত হয়ে শ্বাসকষ্ট, চর্ম ও হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। আবার লোকালয় ও নদী থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউই তা মানছেন না। কৃষিজমিতে ইটখোলা তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারও তোয়াক্কা করছেন না কেউ। উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি ও পরিসংখ্যান অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনের তালিকায় রূপগঞ্জে ৪০টি ইটভাটা রয়েছে। আর তালিকার বাইরে আছে আরও ৮৫টি। এসবের মধ্যে মাত্র চারটির বৈধতা রয়েছে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মাসাবো, তেতলাবো, বরপা, কর্ণগোপ, সাঁওঘাট, গোলাকান্দাইল, আওখাবো, বলাইখা, বেলদি, দেবই, কামালকাঠি, আতলাপুর, ভোলাবো, চারিতালুক, বিরাবো, কাঞ্চন আশপাশের এলাকার অবৈধ ইটভাটায় অবাধে কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাতের আঁধারে ভেকু দিয়ে কৃষিজমি গভীর খনন করে মাটি কেটে ইটভাটাগুলোতে সরবরাহ করছে। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি।
দাউদপুর ইউনিয়নের রোহিলা এলাকার কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, চার বিঘা জমিতে আমি ধান চাষ করি। কিন্তু এ বছর পাশের জমি ভেকু দিয়ে গভীর খনন করে মাটি কাটায় আমার জমিসহ পাশের জমি সৃষ্ট গর্তে ভেঙে পড়ছে। এ বছর ধান চাষ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।
ভোলাবো ইউনিয়নের আতলাপুর এলাকার কৃষক আব্দুল বাতেন বলেন, মাটি খেকোরা ভেকু দিয়ে কৃষিজমির মাটি কেটে নিচ্ছে। বাধা দিলে ভয়ভীতি ও হামলা মামলা করা হয়। সেচ প্রকল্পের খালে বাঁধ দিয়ে তাদের ব্যবহৃত পরিবহন চলাচল করে। ফলে পানি সংকটে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, প্রশাসন, থানা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও এলাকার মাস্তানদের ‘ম্যানেজ’ করেই এসব ইটভাটা চালাচ্ছে মালিক পক্ষ। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও কয়েক দিন পর আবারও চালু হয়ে যায় ইটখোলাগুলো।
রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নূর বলেন, ইটভাটাগুলোর কারণে ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। আগে বিঘায় এখানে ধান উৎপাদন হতো ৩০ মণ। এখন বিঘায় ২৫ মণ উৎপাদন হয়।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভী ফেরদৌস বলেন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লোকজন শ্বাসতন্ত্র, ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। অতিরিক্ত দূষিত বায়ু সেবনে গর্ভে থাকা শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
দুয়ারা এলাকার ইটভাটার মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, ইটভাটার কারণে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ কাজ করে খাচ্ছেন। আমরা তো ক্ষতি করছি না।
একই কথা জানিয়ে আরেক মালিক মজিবুর রহমান বলেন, আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেই ইটভাটা চালাচ্ছি।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। সামনে আবারও অভিযান চলবে।
রূপগঞ্জ ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল কালবেলাকে বলেন, কয়টি ইটভাটায় অনুমোদন ও পরিবেশের ছাড়পত্র আছে তা খতিয়ে দেখে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ ব্যাপারে কথা হয়েছে জেলা প্রশাসকের সাথে, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন অবৈধ ইটভাটাগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
মন্তব্য করুন