সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন করেছে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি না হলে এসব সংস্কার টেকসই হবে না। অতীতেও দেখা গেছে, ঐকমত্য না থাকায় অনেক সংস্কার টেকেনি। দেশে যে গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়েছে, তা সব সময় সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যে-সব সংস্কার এখন করা হবে, নির্বাচিত সরকার সেগুলো টিকিয়ে রাখবে।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) বাংলার পাঠশালা আয়োজিত অর্থনৈতিক সংকট ও উত্তরণে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন। সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ।
অর্থনৈতিক সংকট ও উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যদিও সবকিছু প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক করে ফেলা হয়েছে।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, ওই সময়ে মানব উন্নয়নে যে জোর বা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল এবং যার বাস্তবতা ছিল, তা করা হয়নি। বরং দেখা গেছে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। ফলে স্থিতিশীলতার একটি দশক একভাবে হারিয়ে গেছে। অথচ তখন মানব উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হলে তার সুফল আমরা পেতাম।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যদিও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়েনি বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান। সে কারণে তরুণেরা সরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। অথচ দেশের মোট কর্মসংস্থানের মাত্র পাঁচ শতাংশ সরকারি খাতে হয়। সেখান থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের অভিযোগ, বাংলাদেশে প্রতিযোগতিামূলক বাজার কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এখানে যে চাহিদা- জোগানের ভিত্তিতে বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ হবে বা কেউ অবাধে ব্যবসা করে বড় হবে, সেই সুযোগ কম। সবকিছু নির্দিষ্ট কিছু গোষ।ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, দেশে কোনো খাতে তিন-চারটির বেশি কোম্পানি দেখা যায় না। সরবরাহ ব্যবস্থার সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে- উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহণ ও বিপণন। এমনকি তারা সরবরাহ ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্যও দিতে চায় না। ফলে গবেষণা করা যায় না। গোলাম মোয়াজ্জেমের অভিযোগ, এরা সংস্কার কেউ চায় না। বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখলে যাদের সুবিধা, তাঁরা সব সসময় সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আলোচকেরা দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের অভাবকে চিহ্নিত করেন। তাঁরা বলেন, মূলত বেসরকারি খাতে শোভন কর্মসংস্থানের কারণে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এখন যে বাস্তবতা, তাতে আগামী দুই বছরে বা মধ্য মেয়াদে যে কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমন সম্ভাবনা কম। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা না হলে আগে যে পরিস্থিতি ছিল, তাই থেকে যাবে, উত্তরণ হবে না।
হেলাল উদ্দিন বলেন, যেকোনো রোগের চিকিৎসায় সবার প্রথমে দরকার রোগ নির্ণয়। এটি ঠিকঠাক হলে রোগ অর্ধেক ঠিক হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে নিজের এক গবেষণার সূত্রে তিনি বলেন, দেশে পাঙাস মাছের দাম গত ১০ বছরে যে তেমন একটা বাড়েনি, তার কারণ হলো উৎপাদন ব্যয় কমে যাওয়া। এই পাঙাসের বাজারে সিন্ডিকেট খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হেলাল উদ্দিন আরও আরও বলেন, চালের দামও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি, তার কারণও এই উৎপাদন মূল্য। তিনি বলেন, মূল বিষয় হলো উৎপাদন খরচ। তা কমানো গেলে এমনিতেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। আবার কখনো কখনো বাজার কয়েকটি কোম্পানির হাতে থাকলে উৎপাদন ব্যয় কমে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহান। তিনি বলেন, অর্থনীতি নিছক কারিগরি বিষয় নয়; এর সঙ্গে রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার সম্পর্ক আছে। সইে সঙ্গে তার একটি আইনি দিকও আছে। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর যেমন আপাত দিক আছে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি ও মৌলিক দিক আছে। দুটো একসঙ্গে করা দরকার।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল, সাংবাদিক ও লেখক আমিন আল রশিদ, ইস্ট -ওয়েস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক নাবিলা ফারহিন প্রমুখ।
মন্তব্য করুন