পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আগের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও কোনো সদিচ্ছা দেখায়নি। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এই চুক্তির বাস্তবায়নে মূল বাধা। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
শুক্রবার (২০ জুন) সংগঠনটির আয়োজনে ধানমন্ডির উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব অভিযোগ উঠে আসে।
সভায় মূল প্রবন্ধে লেখক ও আদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘বৈষম্যহীনতা ও অন্তর্ভুক্তির কথা বলে যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, সে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমেও আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি সন্তোষজনক নয়। সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্বই নেই। অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশন এখনও পর্যন্ত আদিবাসীদের কার্যকর কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের সঙ্গে কোনো সংলাপ আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। ফলে আগামীর সংস্কার কার্যক্রমে এবং রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে ছয়টি করণীয় নির্ধারণের ব্যাপারেও পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে-পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ে বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করা। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বপ্নভঙ্গ হওয়া তারুণ্যের দ্রোহী প্রতিরোধই এ অঞ্চলের সমস্যার সমাধানে অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করেন সতেজ চাকমা।
সভায় দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমি এখনো আশাবাদী, তারা বৈষম্যবিরোধী এবং আদিবাসীদের জন্য কিছু করবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্বের অনেকগুলো দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জন করেছে, তা নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু নিজের দেশে তারা কেন পারছে না? এই প্রশ্নটা করতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আদিবাসী শব্দটি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। আদিবাসী নেই, এটা প্রচার করতে পারলে তাদের অধিকারের বিষয়টিও আর থাকে না। আমাদের দেশে অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। আমরা বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ চাইবো, অথচ আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, তা তো হয় না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শ্রী ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আমরা এখানে যে দাবি নিয়ে কথা বলছি, তা সরকারের দায়িত্বশীলদের কানে কতটা যাবে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। আর কানে গেলেও তারা সেটি কতটা গুরত্ব দেবেন, তা নিয়েও সন্দিহান।’ পাহাড়ের মানুষ অনেক আশা নিয়ে শান্তি চুক্তি করেছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে আক্ষেপও করেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘৩৩ বছর আগেও আমি আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে যে দাবি করেছি আজও একই দাবি নিয়েই কথা বলছি। তাহলে আমরা কোথায় এগিয়েছি? এই অঞ্চলজুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার মধ্য দিয়ে যে ঘটনা ঘটবে তাতে জঙ্গিগোষ্ঠী, আধিপত্যবাদ বিস্তার পাবে। এর ফলে ওই অঞ্চলে আরও সামরিকীকরণ ঘটবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হওয়া উচিত।’
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘রাষ্ট্র যখন দানবের মত আচরণ করে, তখন সাধারণ মানুষের জায়গা থাকে না। রাষ্ট্র সভ্য কি না, তা বোঝা যায়- যখন রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ভালো থাকে। মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, লুটেরা শ্রেণির ভালো থাকা দিয়ে রাষ্ট্রকে সভ্য বলা যায় না।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন এএলারডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন আদিবাসী ফোরামেত সহসভাপতি অজয় এ মৃ। সঞ্চালনা করেন হিরণ মিত্র চাকমা।
সভায় জানানো হয়, সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় স্বাধীনতার পর থেকে পার্বত্য চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি এবং ১ হাজার ৪৪৬ জন বাঙালি। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ সদস্য নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন। কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি।
জনসংহতি সমিতির তথ্য তুলে ধরে সভায় বলা হয়, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ২৯টি ধারার সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত এবং ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করে আদিবাসী ফোরাম। বিগত ১০ মাসে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চরম নিরাপত্তাহীনতায় এবং নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারে পরিণত হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়।
মন্তব্য করুন