জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও বৈষম্যহীন এবং পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষার অগ্রগতি এখনো সেভাবে হয়নি। পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের যথাযথ সংস্কার ও এটিকে জনবান্ধব করার উদ্যোগও স্তিমিত হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।
বুধবার (২০ আগস্ট) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্যহীন ও পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক জুলাই সংলাপে তারা এ মন্তব্য করেন তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে সংলাপ শুরু হয়। তিনি বলেন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী এবং নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের আঁতাতের কারণেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন, নাগরিক সুবিধাদি, দেশের বিভিন্ন এলাকার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিভিন্ন নীতি পরিকল্পনা প্রণয়নে আগের মতোই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রকে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর বিপরীতে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণহীন, জবাবদিহিমূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত ও টেকসই বাংলাদেশ পুনর্গঠনকে প্রাধিকার দিতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এ জন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গোষ্ঠীস্বার্থের বিপরীতে জনস্বার্থ এবং টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জুনায়েদ ইসলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও হামলার শিকার হয়েছিলেন।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়ের মা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শামসি আরা জামান জানান, ১৯ জুলাই শহীদ প্রিয়র মৃত্যুর পরদিন থেকেই পরিবারকে মিথ্যা মামলা, হুমকি ও বাসায় হামলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। পরে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে পরিবার ঢাকার নিউমার্কেট থানা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতিতে শহীদ পরিবারগুলো গভীরভাবে হতাশ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের ওপর গণহত্যা বন্ধ করতে তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন। সেই সময় গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখেন, যেসব শিক্ষার্থীর জন্য আন্দোলন করেছিলেন পরে বিভিন্নভাবে তাদের অনেকেই জুলাই গনঅভ্যুত্থানে নিজের অবদান নিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে।
স্থপতি ফারহান শারমিন বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর,সরকারি হাসপাতালের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আহত ব্যক্তি ছিলেন যারা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান, কিন্তু পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। আহতদের তালিকা ভুক্তিতেও দেখা গিয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
পিআইবি মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা শুধু সংস্কার চাইনি, চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সেভাবে সফল হয়নি, যার মূল কারণ প্রতিদিন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিপ্লব। বিপ্লব ঠেকানোর দায়ভার সরকারের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের নিতে হবে।
বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও জমিন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তার ফলশ্রুতিতেই জুলাই আন্দোলন হয়েছে। আমাদের দেশে অনেক গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থান হয় নি। যার ফলে, দেশে অনার্জিত আয়ের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য উচ্ছেদ করা যায় নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য জুলাই সংলাপে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, পরিকল্পনাবিদ, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির-পেশার মানুষ এবং জাতীয় গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন