ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত সমর্থকদের গ্রেপ্তারে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এমনটা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সংস্থাটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উদ্বেগ তুলে ধরা হয়। সরকার শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ ও জমায়েতের অধিকারকে দমন করছে বলেও প্রতিবেদনে সমালোচনা করেছে এইচআরডব্লিউ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের মানবাধিকার দলের উচিত নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানানো এবং মানবাধিকার রক্ষা ও রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানির পর ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ (কার্যক্রম) করে। দলটির সমর্থনে যেকোনো সভা, প্রকাশনা ও অনলাইনে বক্তব্য দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ও শান্তিপূর্ণ অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারে আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পুরে দেওয়া কিংবা শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশে বাধা দেওয়ার মতো পক্ষপাতমূলক আচরণ অন্তর্বর্তী সরকারের করা উচিত নয়। তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার সঙ্গে কোনো পার্থক্য থাকল না।
মীনাক্ষী আরও বলেন, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সহায়তার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাদের উচিত সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজরদারি করা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা।
এইচআরডব্লিউর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ‘শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে’ হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। অসংখ্য ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক রাখা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করাসহ পুলিশ হেফাজতে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ শেখ হাসিনার শাসনামলের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
গত ২৮ আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাবিদসহ ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। রাজধানীতে সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) কার্যালয়ে প্রকাশ্যে ওই সভার আয়োজন করা হয়েছিল। হঠাৎ একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি সেখানে গিয়ে সভায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ঘিরে ফেলেন এবং তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের অনুগত বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।
সভায় অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না। তিনি নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে ফোন করেন। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তারের বদলে পুলিশ আলোচনা সভায় অংশ নেওয়া ১৬ জনকে আটক করে। এর মধ্যে কয়েকজনের বয়স ছিল ৭০ থেকে ৮০ বছর। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ও সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
শুরুতে পুলিশ পরিবার ও আইনজীবীদের জানিয়েছিল, নিরাপত্তার খাতিরে তাদের আটক করা হয়েছে। পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই মামলায় আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের অভিযোগে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিয়েছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর জামিন শুনানির সময় মঞ্জুরুল আলম পান্নাকে হেলমেট, হাতকড়া ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে আদালতে আনা হয়। সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অন্য এক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান।
গ্রেপ্তার এক ব্যক্তির পরিবারের একজন সদস্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, এমনকি এটি কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও ছিল না। এটি ছিল একটি আলোচনা সভা। তাহলে এটিকে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হবে?
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, এসব মানুষ কারাগারে আছেন। কিন্তু যারা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন, তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ সরকারকে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই মনে হচ্ছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্ষমতায় থাকাকালে এই আইনের অপব্যবহারের জন্য আওয়ামী লীগের সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ২০২৫ সালের সংশোধনী দরকার ছিল।
শান্তিপূর্ণ বক্তব্য ও সমাবেশের অধিকার দমন করা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী। বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিল সতর্ক করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনগুলো মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে, যা উদ্বেগজনক। এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সরকার রক্ষণশীল মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি আদায় করতে গিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের আইন সহায়তা এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার (মব) হামলায় অন্তত ১৫২ জন নিহত হয়েছেন।
একজন রাজনৈতিক কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘হয়তো সন্ত্রাসী হিসেবে কারাগারে থাকা, নয়তো উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার শিকার হওয়া—এ ছাড়া এখন আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। আমি বলছি না যে দোষীদের শাস্তি হওয়ার দরকার নেই। তবে এটি হতে হবে একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অধীনে, যা দিতে ইউনূস সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ঢাকায় তাদের মিশন চালু করতে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তিন বছরের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এ মিশনের উদ্দেশ্য মানবাধিকার রক্ষা ও এর প্রচার। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার তুর্ক বলেন, প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত সহায়তার পাশাপাশি এই মিশন মানবাধিকারের প্রতি দেশটির প্রতিশ্রুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবে, যা পটপরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার বন্ধ করা উচিত। আইনটি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সমার্থক হয়ে উঠছে। এর পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন