দেশে বেআইনি আটকের অভিযোগ ও রহস্যজনক নিখোঁজ, নির্যাতন ও নিপীড়ন, সীমান্তে হত্যাসহ বহুল আলোচিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের ঘটনা বেড়েছে।
সোমবার (৩ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে (জানুয়ারি-জুন ২০২৩) এ তথ্য জানানো হয়। এই ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি ও হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ছয় মাসে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৫৪ নারী-পুরুষ। যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ৭৯ জন নারী ও ৭৫ জন পুরুষ।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের প্রায় সবকটি জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে মোট ৮০৪ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১০৯ শিশু এবং ১ জন ছেলে শিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৪৫ শিশু, বিভিন্ন সময়ে মোট ৮৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৪ শিশুর। এ ছাড়া বলাৎকারের শিকার হয়েছে ২৭ ছেলে শিশু এবং বলাৎকারের চেষ্টা করা হয়েছে ৫ শিশুকে।
ছয় মাসে ১১৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এদের মধ্যে ঢাকায় ২৯ এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার প্রতিটিতে ৮ জন করে সাংবাদিক রয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। এ বাহিনীর হেফাজতে ৪ জন এবং গুলিতে ২ জনসহ মোট ৬ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। এ সময়কালে র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার একটি অন্যতম উদাহরণ।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দায়েরকৃত ২৪টি মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৪টি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার হয়েছে ২৬ জন। এই মামলাগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার দায়ে ৫টি মামলা রয়েছে, যেখানে আসামি করা হয়েছে ৫ জনকে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪ জনকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে এ সময়ে কমপক্ষে ১০ জনসহ মোট ১১ জন বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটেছে এবং ১৪ জন আহত হয়েছে। এ সময়কালে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় বাবা-মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুর ও গাজীপুর জেলায়।
এ সময়কালে স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১৭৯টি। এতে নিহত হয়েছে ১৪ এবং আহত হয়েছেন প্রায় ২৪২২ জন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ৬ জন নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে ৪ জন পুলিশ এবং ২ জন র্যাবের হাতে নিহত হয়।
সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৬ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে পরবর্তীতে ৬ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বছরের এ সময়কালে ৫টি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩টি বাড়িঘরসহ ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও ১৫টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ১ জন নিহত ও কমপক্ষে ৬২ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে কমপক্ষে ১০৩টি বাড়ির ২৫৯টি ঘরে ও ৩৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১১ বাংলাদেশি নাগরিক। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১৪ জন।
এই সময়কালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৫১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৪ এবং হাজতি ২৭ জন।
গত ছয় মাসে গণপিটুনীর ঘটনায় নিহত হন মোট ২৪ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯ জন, খুলনা বিভাগে ১ জন, বরিশাল বিভাগে ১ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন নিহত হয়েছে।
আসক মনে করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আসক রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের সব ধরনের মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
মন্তব্য করুন