সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রধানতম সমস্যা অব্যবস্থাপনা ও কেনাকেটায় দুর্নীতি। এই দুর্নীতি অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে প্রচলিত যে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা রয়েছে এই ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে সম্ভব নয়।
বুধবার (১২ জুলাই) ঢাকার এফডিসিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান পরিস্থিত নিয়ে এক ছায়া সংসদে তিনি এসব কথা বলেন।
ইউসিবি পাবলিক পার্লামেন্ট শিরোনামে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনাতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন জরুরি। বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা বিস্তৃত হলেও এখন পর্যন্ত অনিয়ম নিযন্ত্রণে কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু সাময়িক অভিযান পরিচালনা করলে চলবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় পার্শ্ববর্তী দেশের মতো বছরব্যাপী অভিযান চালাতে হবে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখি ও তার নবজাতক সন্তানের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, নবজাতক ও তার মা আঁখির মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে। তবে খুনিরা যদি জামিন পেতে পারে তাহলে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় যে দুজন চিকিৎসক হাজতে রয়েছেন তাদেরও জামিন পাওয়া উচিত। কারাগারে আটক রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
তিনি বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকদের যখন তখন কর্মবিরতি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে অনেক সময় এমন প্রেক্ষাপট ঘটে যার জন্য চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য খাত। বছরের পর বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের প্রধান মাফিয়ারা। কোন হাসপাতালে কোন যন্ত্রপাতি লাগবে, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানার আগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার মনমতো যন্ত্রপাতির তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে ক্রয় অনুমোদন করে নেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে বহুবার।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায়, রক্তসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে কমিশন বাণিজ্য, ভুঁইফোড় ক্লিনিক দিয়ে দালালদের রোগী ধরার প্রতিযোগিতা, হার্টের চিকিৎসায় রিং বাণিজ্য, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা, কমিশনের জন্য মানহীন ওষুধ প্রেসক্রাইব করা, লাইফ সাপোর্টের নামে মিথ্যাচারসহ নানা অনিয়ম চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে এখনো পেশাদার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা, রাজনীতিকরণ, টেন্ডার বাণিজ্য, বাণিজ্যিকীকরণ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা ক্রমেই কমে আসছে। যা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী, সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, স্টাফ এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগকারী কারও জন্য কল্যাণকর নয়।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু ঘটনা প্রসঙ্গে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ডাক্তার সংযুক্তা সাহার অধীনে আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করলেও ডা. সংযুক্তা সাহা দেশেই ছিলেন না। কীভাবে তা ঘটল, কারা ঘটাল? এটি কী মৃত্যু না হত্যা? এই প্রশ্ন এখন সব মহলে। আর কত আঁখি মারা গেলে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ করেন।
সুপারিশ গুলো হলো—
১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ করা। প্রয়োজন অনুযায়ী অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে জেল-জরিমানার বিধান করা।
২. বিএমডিসির নিবন্ধনহীন এবং নিবন্ধনের মেয়াদ উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার থেকে বিরত রাখা।
৩. সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজকে রাজনীতিমুক্ত রাখা। মেধার ভিত্তিতে সরকারি ডাক্তারদের প্রমোশন, ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ ও নিয়মানুযায়ী পোস্টিং করা।
৪. হাসপাতালে ভর্তিকৃত শংকটাপন্ন রোগীর আত্মীয়স্বজনদের নিকট দৈনিক একবার রোগীর অবস্থা সম্পর্কে ব্রিফিং করা।
৫. হাসপাতাল ক্লিনিকের সেবার মান সম্পর্কে প্রতিমাসে একবার গণশুনানি করা। যেখানে মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, হাসপাতালের মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের জবাব দিবেন।
৬. সুস্পষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণ ব্যতীত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা বা মামলা দায়ের থেকে বিরত রাখা ও গ্রেপ্তার না করা।
৭. হাসপাতালে সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ডাক্তার ও স্টাফদের আকস্মিক ধর্মঘট বা কর্মবিরতি বন্ধ করা।
৮. একাডেমিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না করে মেডিকেল কলেজের অনুমোদন না দেওয়া।
৯. বেসরকারি হাসপাতালে পূর্ণকালীন ডাক্তারদের জন্য পদভিত্তিক বেতন কাঠামো ঠিক করা।
১০. থাইল্যান্ডের মতো মেডিকেল এবং ডেন্টাল স্নাতকদের বিএমডিসির যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় পাসের সাপেক্ষে প্র্যাকটিস করার অনুমোদন ও নবায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা প্রধান কারণ’ শীর্ষক ছায়া সংসদে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিতার্কিকদের পরাজিত করে প্রাইম ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা চ্যাম্পিয়ন হয়।
প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন সাংবাদিক মাঈনুল আলম, সাংবাদিক জান্নাতুল বাকেয়া কেকা, সাংবাদিক মো. বোরহানুল আশেকীন, সাংবাদিক হিমেল মাহবুব এবং উন্নয়ন গবেষক জাহিদ রহমান। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি ও সনদপত্র দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন