রোহিঙ্গাদের জন্য শক্তিশালী এবং চলমান সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কারিতাস ইন্টারন্যাশলিজের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যালিস্টার ডাটন। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে তিনি বিশ্ববাসীকেও তাদের জন্য কিছু করার আহ্বান জানান।
ডাটন বলেন, ‘গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যে আতিথেয়তা দেখিয়েছে এবং যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, তাতে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। বিশ্বের মনোযোগ যখন সরে গেছে, তখনও রোহিঙ্গারা এই সব ভুলে যাওয়া শিবিরে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার একাই তাদের সহযোগিতা করবে এটা আশা করা উচিত নয়। অন্যান্য দেশগুলোকেও আরও তহবিল নিয়ে এই সংকটকালীন সময়ে তাদের পাশে থাকা প্রয়োজন।’
ডাটন কক্সবাজারে সরকারি, জাতিসংঘ ও এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবং ঢাকায় আর্চবিশপ ও ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বর্তমান পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জ বিষয়ে ক্যাম্পের কর্মী এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (এফডিএমএন) সঙ্গে কথা বলেন।
ডাটন বলেন, ‘আমাদের রোহিঙ্গা জনগণকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়, এমনকি বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনও গ্রহণ করা উচিত নয়। আজ বিশ্বের সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষদের মধ্যে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোও রয়েছে, যারা কাজ করার কোনো অধিকার ছাড়াই প্রান্তিক ভূমিতে বসবাস করছে। এখন যারা কিশোর-কিশোরী, তারা তাদের জীবনের অর্ধেক সময়ই এই বসতিতে কাটিয়েছে। এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের আরও কিছু করতে হবে এবং ভবিষ্যতের বিকল্পগুলোও তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।’
২০১৭ সালে শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে নাটকীয়ভাবে অর্থায়ন কমে গেছে। উদ্বাস্তুদের খাদ্য সহায়তার জন্য প্রতি মাসে প্রতি জনের জন্য বিশ্বব্যাপী তহবিল ১১ ডলার হ্রাস করা হয়েছে, অন্যান্য খাতের তহবিলও উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক বেশি কমে গেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৩০০% হয়েছে। বসবাসের অবস্থারও অবনতি ঘটছে, কারণ বসতিগুলোর জন্য আশ্রয় মেরামতসহ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটের জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্বে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ৮৫২.৪ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে, এই পরিকল্পনাটি ১.৩৫ মিলিয়ন মানুষকে রোহিঙ্গা এবং আশ্রয়দানকারী কমিউনিটিতে নিরাপদ আশ্রয়, শিক্ষা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসাসেবা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং জীবিকা ও অবকাঠামোগত প্রকল্পে সহায়তা করবে। গত বছর সাড়াদান পরিকল্পনায় মাত্র ৬৫% তহবিল সংগৃহিত হয়েছে এবং পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হতে চলেছে।
২০১৭-২০২৩ পর্যন্ত কারিতাস কক্সবাজার এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দানকারী কমিউনিটির সদস্যদের জন্য জরুরি সহায়তা হিসাবে ৪৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে। এই সময়ে কারিতাস রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে সাড়া প্রদানসহ ১.৭ মিলিয়ন মানুষকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে যার মধ্যে রয়েছে আশ্রয় সহায়তা, সুরক্ষা, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম, শিক্ষা, পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থবিধি। কারিতাস ২০২৪ সালের জন্যও অতিরিক্তি ৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ডাটন বলেন, ‘গত ছয় বছরে ক্যাম্পে ২০০,০০০ এরও বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে। এই শিশুরা কখনই তাদের নিজ দেশ দেখেনি এবং তাদের কোনো জাতীয়তা নেই। তারা রাষ্ট্রহীন। এই বিষয়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মিয়ানমারের উপর চাপের পাশাপাশি এই অঞ্চল এবং এর বাইরের দেশগুলিকে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।’
সেক্রেটারি জেনারেল এর বাংলাদেশ সফর রোহিঙ্গাদের জন্য পোপ ফ্রান্সিসের সাম্প্রতিক নবায়নকৃত আবেদনকে প্রতিফলিত করে উদ্বাস্তুদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছে। পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালে বাংলদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গাদের একটি দলের সাথে দেখা করেছিলেন। ঢাকায় মিরপুরের আরামবাগে একটি ড্রপ ইন সেন্টার (কারিতাস বাংলাদেশ পরিচালিত পথশিশুদের সহায়তা প্রকল্প) পরিদর্শনের মাধ্যমে ডাটনের বাংলাদেশ সফরের কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস প্রকল্পের সাথে জড়িত পরিবারের সাথে দেখা করতে রজনীগন্ধা বস্তিতেও যান। ডাটন বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার, কারিতাস বাংলাদেশ এবং স্থানীয় সম্প্রদায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলির জন্য মানবতা, সমবেদনা এবং সংহতি দেখিয়েছে যা দেখে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং এই অনুপ্রেরণা নিয়েই আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করব। এই রোহিঙ্গা পরিবারগুলির জন্য আমাদের মনোযোগ, সম্পদ, ভালোবাসা এবং প্রার্থনা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। সম্মিলিতভাবে মানবতার জন্য আমি সকলের নিকট এই আহবান জানাচ্ছি।’
সেক্রেটারি জেনারেল গুরুত্বের সাথে জানান যে, বহু বছর ধরেই কারিতাস বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে অভাবী মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছে। এই বছর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে দেশের এক লাখ ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সময়ে কারিতাস বাংলাদেশের কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা কমিউনিটির সাথে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি এবং খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা, হাইজিন উপকরণ বিতরণের কাজ করেছে।
উল্লেখ্য, অ্যালিস্টার ডাটন ৯ বছর কারিতাস স্কটল্যান্ডের প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর কারিতাস ইন্টারন্যাশলিজ এর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। তিনি পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যের ষাটটিরও বেশি দেশে আর্ন্তজাতিক ত্রাণ ও উন্নয়ন খাতে কাজ করেছেন। জেসুইট রিফিউজি সার্ভিসের জন্য একজন জেসুইট নবীস হিসেবে কারিতাস নেপালে তিনি এই সেক্টরে কাজ শুরু করেন। কারিতাস ইন্টারন্যাশলিজ হলো ১৬০টিরও বেশি সদস্যের একটি কনফেডারেশন যা বিশ্বব্যাপী প্রায় প্রতিটি দেশে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ প্রতিটি জাতীয় কারিতাস সদস্য কারিতাস ইন্টারন্যাশলিজ এর নিজস্ব সংবিধানের অধীনে কাজ করে। কারিতাস ইন্টারন্যাশলিজ এর সদর দপ্তর রয়েছে রোমে যা জরুরি কার্যক্রম সমন্বয়সহ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে এবং সবার জন্য একটি উন্নত বিশ্বের পরামর্শ দেয়। জাতীয় কারিতাস সংস্থাগুলি নিজ নিজ আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক কনফেডারেশনেরও সদস্য।
কনফেডারেশনের নেতৃতে থাকা টোকিও-র আর্চবিশপ টারকিসিয়াস ইসাও কিকুচির প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, সাথে সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে রয়েছেন মি. অ্যালিস্টার ডাটন। কারিতাস বাংলাদেশ (সিবি) হলো একটি অলাভজনক জাতীয় সংস্থা যা ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অফ বাংলাদেশ (সিবিসিবি) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কল্যাণ এবং অবিচ্ছেদ্য মানব উন্নয়নের জন্য নিবেদিত। বর্তমানে সিবি ৫৩টি জেলা জুড়ে ১৮৭টি উপজেলায় কাজ করছে এবং ১০০টিরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পগুলি ছয়টি মূল অগ্রাধিকারের সাথে জড়িত: দুর্বল সম্প্রদায়ের জন্য সামাজিক কল্যাণ; টেকসই কৃষির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষাকরণ এবং জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ; শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন; পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা; এবং আদিবাসীদের উন্নয়ন।
মন্তব্য করুন