মাহবুবা জেবিন
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে আছেন মাহবুব আলী খান

মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে আছেন মাহবুব আলী খান

‘উদয়ের পথে শুনি কার বানী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয়নাই তার ক্ষয়নাই।’ যুগে যুগে মহৎ কর্ম মানুষকে অমর করে রেখেছে। কাজের মাধ্যমে তারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তেমনি সাহসিকতা, নির্ভীক দেশপ্রেম আর জনকল্যাণ মূলক কাজের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে আছেন প্রয়াত রিয়ার এডমিরাল মাহাবুব আলী খান।

১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহিমপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় এক নক্ষত্রের। আহমেদ আলী খান ও জুবাইদা খানমের কোল আলোকিত করা মাহবুব আলী খান আমৃত্যু তার এই আলো ছড়িয়ে গেছেন। তার শৈশবের বেশির ভাগ কাটে সিলেট এবং অবিভক্ত ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার পিতার কর্মস্থল কোলকাতায়। সেখানেই শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। পরবর্তীতে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। সারাজীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কখনো দ্বিতীয় হননি। ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের দরমাউথে রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৬৩ সালে মাহবুব আলী খানকে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেন।

১৯৭১ সাল। মাহবুব আলী খান তখন কর্মস্থল করাচীতে। পাকিস্তানিরা তখন বাঙালি অফিসারদেরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতে থাকে। মাহবুব আলী খান যখন দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাকে সপরিবারে নজরবন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু তিনি ব্যাকুল হয়ে পরেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। একদিন আসে পাকিস্তানী বাহিনীর আগলমুক্ত হবার সেই মহেন্দ্রক্ষণ। সাজানো সংসারের সব কিছু ফেলে এক কাপড়ে চলে আসার সময় স্ত্রী আফসোস করলে তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী কে বলেন-‘আমি যে তোমাকে স্বাধীনতা দেব’। এরপর প্রথম সুযোগ পেয়েই দেশের উদ্দেশে বেড়িয়ে পরেন। সাথে নারী ও শিশুদের নিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো খচ্চরের পিঠে চড়ে পৌঁছান আফগানিস্তান। সেখান থেকে ভারত হয়ে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।

দেশে ফিরেই বিধ্বস্ত দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পরেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে চট্টগ্রামের মার্কেন্তাইল একাডেমিতে কমান্দান্ট হিসেবে যোগ দেন মাহবুব আলী খান। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ নেভির অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ অফ নেভাল স্টাফে উন্নীত হন । তিনি হন বাংলাদেশ নেভাল শিপ ‘ওমর ফারুকের’ ক্যাপ্টেন । তার নেতৃতে বি এন এস ‘ওমর ফারুক’ আলজেরিয়া , যুগোস্লাভিয়া, মিশর, শ্রীলংকা, সৌদিআরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন নৌবন্দরে ভ্রমন করে এবং বাংলাদেশের নৌশক্তিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৭৭৯ সালে তিনি চীফ অফ নেভাল স্টাফ হন। ১৯৮০ সালে রিয়ার অ্যাডমিরাল পদমর্যাদা লাভ করেন মাহবুব আলী খান।

নৌবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ মূলক কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি স্থাপন করেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল । সমাজের অবহেলিত শিশুদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরভি’ মাহবুব আলী খান এর অনুপ্রেরণায়ই গড়ে উঠেছে । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় কন্যা শাহিনা খান জামান ‘সুরভি’ এর মাধ্যমে ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।

পারিবারিক জীবনে মাহবুব আলী খান ছিলেন খুবই সাধারণ । স্বামী হিসাবে তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুপ্রতিম । পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ত দিতেন ।এমনকি ছোটদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতেন । বড় ভাই এবং বড় বোনএর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল । ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাশুড়িকে খুবই সম্মান করতেন।

স্নেহময় পিতা মাহবুব আলী খান সন্তানদের নিয়মানূবর্তিতা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশী । তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। তাই সমাজ কল্যাণে তাঁর কন্যাদের ছোটবেলা থেকেই উৎসাহিত করতেন তিনি । তিনি বলতেন –‘বড় কিছু পাওয়া মানে অহংকারী না হওয়া’ । বিনয় নম্রতা ছিল মাহবুব আলী খান এর সবচেয়ে বড় গুন । সন্তানদেরকে সর্বদা বিনয়ী হবার শিক্ষাই দিয়েছেন । ছোট বড় সবার সাথে সমান ভাবে মিশার শিক্ষাও তিনি সন্তানদের দিয়েছেন।

নারী শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন মাহবুব আলী খান । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে বিবাহের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছেন । তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি ফাইন আর্টসে পড়াশুনা শেষ করেন । শিল্প ও সঙ্গীত অনুরাগী মাহবুব আলী খানের আগ্রহে তিনি শিখেছেন পিয়ানো বাদন । সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী হিসাবে আজও নিরলশভাবে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।

খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আসক্তি । তরুণ বয়সে খেলেছেন ফুটবল। টেনিস আর সুইমিঙের প্রতি তার ছিল আলাদা টান । মাহবুব আলী খান ছিলেন হ্যান্ডবল এসোসিয়েশনের প্রধান । বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সফল আয়োজক ছিলেন তিনি।

পড়াশুনার পাশাপাশি মাহবুব আলী খান তার মেয়ে শাহিনা খান জামান ও জুবাইদা রহমানকে সবসময় খেলাধুলা, সঙ্গীত চর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন । সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু স্বাধীনভাবে সমাজ কল্যাণ মূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তাঁরই অনুপ্রেরণায় । সাংসারিক কাজের পাশাপাশি জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট , সুরভির প্রতিষ্ঠাতা ও নৌবাহিনী প্রধানের স্ত্রী হিসাবে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন । আর নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মাহবুব আলী খান সব সময় তাঁর স্ত্রীকে পাশে থেকে অনুপ্রাণিত করেছেন । বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সর্বপ্রথম নারী অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের অবদান সবচেয়ে বেশী।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাহবুব আলী খানের অবদান অনস্বীকার্য । বাংলাদেশের জলসীমা রক্ষা, তালপট্টি দ্বীপের দখল নিশ্চিত করা, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুল জলদস্যু মুক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান । তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে মর্যাদা লাভ করে । এমনকি সেই সময় ভারতীয় নৌবাহিনীও বাংলাদেশের নৌসীমায় প্রবেশের সাহস পায়নি।

১৯৮২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব আলী খান । এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ৬ আগস্ট সকালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান দুর্ঘটনা তদন্তে বিমানবন্দরে গেলে কর্তব্যরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে সি এম এইচে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানেই চিকিৎসা রত অবস্থায় মারা যান এই ক্ষণজন্মা পুরুষ।

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের গর্ব রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানকে তাঁর দেশপ্রেম, বীরত্ত, সাহসিকতা, জনকল্যাণমূলক কাজ ও মহানুভবতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে।

লেখক: মাহবুবা জেবিন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রোজাকে বিয়ের পর তাহসানকে আমি শুভেচ্ছা জানিয়েছি : মিথিলা

সুখী দেশ ডেনমার্কের বিমানবন্দর ও সামরিক ঘাঁটিতে গোলযোগ

সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে ট্রাক শ্রমিকদের অবরোধ

এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিতে সাহস পাচ্ছে না ইসি : সারজিস

কোন পদ্ধতিতে ভোট হবে, জানালেন সিইসি

সেই ক্লিপ নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন তাসনিম জারা

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস উদযাপন

নোয়াখালীর শীর্ষ মাদক কারবারি বুলেট ফারুক গ্রেপ্তার

প্রেমিকের দেখা পেতে বাসে উঠে ঘুম, অতঃপর...

রাউজানে অস্ত্র-গুলিসহ ‘সন্ত্রাসী’ ওসমান গ্রেপ্তার

১০

বিআইডব্লিউটিএতে ২ শতাধিক পদে বড় নিয়োগ, আবেদন যেভাবে

১১

পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ

১২

বিপাকে আমির খানের প্রেমিকা

১৩

বাংলাদেশে অনলাইন রিয়েল এস্টেটের নতুন ঠিকানা মানসীড়

১৪

প্রতারক চক্র সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের

১৫

বিগ ব্যাশে যোগ দিলেন অশ্বিন 

১৬

বাংলাদেশ রেলওয়ের জরুরি বিজ্ঞপ্তি

১৭

স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে রেহাই পেলেন না স্বামী

১৮

ঘোষণা শুনেই বাজারে বাড়ল খোলা তেলের দাম

১৯

চলন্ত ট্রেনের হুকে ৫ মিনিট আটকে ছিলেন নারী, অতঃপর...

২০
X