রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আল জাজিরা
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:২৯ পিএম
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৪২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনিচ্ছুক কারা এই ‘হারেদি’ ইহুদি গোষ্ঠী?

‘হারেদি’ ইহুদি গোষ্ঠী। ছবি : সংগৃহীত
‘হারেদি’ ইহুদি গোষ্ঠী। ছবি : সংগৃহীত

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে খসড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কট্টর ধর্মীয় ইহুদি সম্প্রাদায়ের (আল্ট্রা-অর্থডক্স জিউস) মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে এবং এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। এতদিন কেবল ‘হারেদি’ ইহুদি ব্যতিত সবার জন্যই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ ও সার্ভিস বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এবার তাদেরও বাধ্যতামূলক আইনে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে বিক্ষোভ চলাকালীন হারেদি পুরুষরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

এমনকি পার্লামেন্টে গোষ্ঠীটির প্রতিনিধিত্বকারী নেতাদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। রোববার হারেদিদের একটি গ্রুপ ‘ইউনাইটেড তোরাহ জুডিয়াজম পার্টি’র প্রধানের গাড়িতে হামলা চালায়। এখন প্রশ্ন হলো- একটি দেশের বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিস থেকে কেন কট্টরপন্থীরা ছাড় পাবে এবং ওই নীতির পরিবর্তন নিয়ে কেনইবা তারা এত ক্ষুব্ধ।

আল্ট্রা-অর্থোডক্স ইহুদি এবং ‘হারেদিম’ কারা? হারেদিম (একবচন-হারেদি) হলো- কট্টর ধর্মীয় ইহুদিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হিব্রু শব্দ। তারা সবচেয়ে কঠোরভাবে ইহুদি ধর্ম পালনকারী সম্প্রদায়। এমনকি তারা প্রার্থনা এবং উপাসনায় আত্মনিয়োগ করার জন্য নিজেদেরকে সমাজ থেকেও আলাদা করে রাখেন। হারেদিদের রয়েছে বিশেষ ধরনের পোশাক। নারীরা মাথা ঢেকে রাখার পাশাপাশি শালীন লম্বা পোশাক পরিধান এবং পুরুষরা কালো স্যুট বা ওভারকোট এবং বড় পশমের টুপি পরেন। তাদের জীবনাচরণেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। নিজেদের এবং সম্প্রদায়কে তারা বাইরের বিশ্ব থেকে যতটা সম্ভব আলাদা করে রাখেন। পার্থিব সাধনার মাধ্যমে শুদ্ধতা লাভের আশায় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেও নিজেদের বিরত রাখেন। হারেদি ইহুদিরা, প্রধানত জেরুজালেম এবং বেনি ব্র্যাক শহরে বসবাস করে। তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে না এবং শুধু তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিদ্যালয়ে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে।

১৯ শতকে ইউরোপে যখন বিশ্বকে আধুনিকীকরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তখন হারেদি মুভমেন্টকে চিহ্নিত করা হয়। সেসময় প্রথম দিকে তারা এই শঙ্কায় ছিল যে, ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যেতে পারে।

কেন হারেদিম সামরিক দায়িত্ব পালন করছিল না? ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের আগে হারেদিমকে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সার্ভিস থেকে নিষ্কৃতি দিতে ‘তোরাতো উমানুতো’ (যার অর্থ ‘তোরাহ বা তাওরাত অধ্যয়ন তার কাজ’) বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়।

যদিও এই ব্যতিক্রমটি ছিল অল্প সংখ্যক সিনিয়র ছাত্রদের জন্য যারা, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ‘ইয়েশিভাস’ নামক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ইহুদিদের পবিত্র বই অধ্যয়ন করতো। তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে, তাওরাত অধ্যয়ন, বা এটি তেলাওয়াতের মাধ্যমে ইসরায়েলি জনগণকে হুমকি থেকে রক্ষা করা সম্ভব। যদিও অর্থোডক্স ইহুদি বা হারেদিম সংখ্যায় ইসরায়লে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি গোষ্ঠী ছিল। ফলে, তখন সমস্যাটিকে ততটা বড় হিসেবে দেখা হয়নি।

কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ইসরাইলে এখন হারেদিমের সংখ্যা আকাশচুম্বী। বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার হারেদি যুবক রয়েছে যাদের ১৮ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বয়সে পৌঁছেছেন। কিন্তু তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই তালিকাভুক্ত হয়নি। গত বছর ৬৬ হাজার হারেদিম তালিকাভুক্ত হয়নি।

এরপর কী হবে? কেন জনগণ অখুশি? গাজায যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্য নিহত ও আহত হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবারও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। কারণ, অনেক সক্ষম যুবক এখও যুদ্ধে না গিয়ে বসে আছে। কিন্তু এটিই তাদের ক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়। বছরের পর বছর ধরে, ইসরায়েলি সরকারগুলো- বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর নেতারা আল্ট্রা- অর্থডক্স ইহুদিদের সামরিক বাহিনীর বাধ্যতামূলক সার্ভিসে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়ে আলোচনা করে আসছেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারেননি। অথচ, হারেদিমের আকৃতি ক্রমে বাড়ছেই।

সবশেষ গত ২৫ জুন এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করলে সামরিক বাহিনী ইয়েশিভা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে খসড়া আইন প্রস্তুত করে। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে রুল জারি করে যে, যেসব ইয়েশিভা শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেনি, তারা সরকারি সহায়তা পাবে না। এটি হারেদি সম্প্রদায়ের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা এতদিন সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ধারণার তীব্র বিরোধিতা এবং এ ব্যাপারে লবিং করে আসছিলেন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু এতে অন্য ইহুদিরা হারেদিদের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। কারণ, সাধারণ ইসরায়েলিদের দেয়া ভর্তুকি সুবিধা ভোগ করলেও অর্থডক্স ইহুদিরা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে আসবে না এটি তারা মানতে পারছেন না। এর ফলে হারেদি বিক্ষোভকারীদের ওপর অন্য ইহুদিদের হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

কেন হারেদিমরা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের প্রবল বিরোধিতা করছে? সামরিক বাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণ করতে না চাওয়ার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত তারা বিশ্বাস করে যে, সেনাবাহিনীতে যোগদান তাদেরকে তাওরাত অধ্যয়ন থেকে বিচ্যুত করবে, অথচ, এটিই তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তির ফলে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমানে যে স্বাতন্ত্র্য জীবন পরিচালনা করছেন, সেটি আর থাকবে না। এ ছাড়া, অনেকে বিশ্বাস করেন যে, তাদের মূল্যবোধগুলো সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের জন্য বিশেষ আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীরা যাতে পুরুষদের সংস্পর্শে আসতে না পারে এবং তাদের প্রার্থনার জন্যও দীর্ঘ সময় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

এ ছাড়া, অনেক হারেদিম জায়নবাদের বিরোধী। এমনকি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করেন অনেক আল্ট্রা-অর্থোডক্স ইহুদি। ২০২১ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ৭৩তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় হারেদিরা জেরুজালেমের মেয়া শেয়ারিম এলাকায় ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলনের সময় ইসরায়েলি পতাকা পুড়িয়ে দেয়। সেসময় তারা ফিলিস্তিনি পতাকা বহনের পাশাপাশি ‘জায়নবাদ ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করে না’ বলে স্লোগান দেয়। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, ইসরায়েল রাষ্ট্র শুধু মসীহের (হযরত ঈসা আ.) আগমনের পরেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এমনকি হারেদিদের একটি অংশ ফিলিস্তিনিদের উল্লেখযোগ্য সমর্থক হয়ে উঠেছে।

(আল জাজিরা অবলম্বনে অনূদিত। অনুবাদ : মোহসিন কবির)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় ড. ওবায়দুল ইসলামের উদ্যোগে দোয়া মাহফিল

খালেদা জিয়ার আরোগ্য লাভের অপেক্ষায় কোটি জনতা : অপর্ণা রায়

ঢাকায় রুশ গণ-কূটনীতির শতবর্ষ উদযাপন

ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধ : মুফতি মোস্তফা কামাল

দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্দুকধারীদের নির্বিচার গুলি, শিশুসহ অন্তত ১২ জন নিহত

সুখে-দুঃখে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি শুভ্রার

ঘুষ নেওয়ার সংবাদ প্রকাশ / সাংবাদিককে গালি দিয়ে ভূমি কর্মকর্তা ফেসবুক পোস্ট

কুয়াশা নিয়ে যে তথ্য জানাল আবহাওয়া অফিস

নির্ধারিত সময়ের আগে অফিসে প্রবেশ, নারী কর্মীকে চাকরিচ্যুত করল কোম্পানি

শহীদ শিহাবের কবর জিয়ারতে জেলা এনসিপির নতুন কমিটির নেতারা

১০

২-৪টা আসনের জন্য কারও সঙ্গে জোট করব না : নুর

১১

‘আমাকে সাসপেন্ড করেন’ বলতে থাকা চিকিৎসককে অব্যাহতি

১২

বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার বিকল্প কেউ নেই : কায়কোবাদ

১৩

গণতন্ত্র উত্তরণে খালেদা জিয়ার বেঁচে থাকা জরুরি : অমিত

১৪

চিকিৎসায় অবিশ্বাস্য সাফল্য, ৩ দিনেই ক্যানসার থেকে সুস্থ হলেন নারী

১৫

‘টাইম টু টাইম’ শাশুড়ির স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখছেন ডা. জুবাইদা

১৬

বিএনপি সবসময়ই ‘পলিটিক্স অফ কমিটমেন্টে’ বিশ্বাসী : রিজভী

১৭

বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হবে : গণশিক্ষা উপদেষ্টা

১৮

মির্জা আব্বাসের আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী ভিপি সাদিক কায়েম

১৯

‘দেশের অগ্রযাত্রায় প্রবাসী তরুণদের জ্ঞান-প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে যুক্ত করতে হবে’

২০
X