রেজোয়ান হক
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

জিয়া এবং বেগম জিয়া’র বঙ্গবন্ধু ভাবনা

মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক রেজোয়ান হক। ছবি : সংগৃহীত
মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক রেজোয়ান হক। ছবি : সংগৃহীত

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এর সুবিধাভোগী তৎকালীন ডেপুটি আর্মি চিফ জিয়াউর রহমান এবং তার স্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মনোভাব কী ছিল তা সবচেয়ে ভালো জানবেন তাদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা। বিএনপির এমন দুই সিনিয়র নেতার লেখায় তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাফিজউদ্দিন আহমেদ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর ছিলেন। ‘সৈনিক জীবন-গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ নামে লেখা তার আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে। জনাব হাফিজের নিজের ভাষায়- ‘ওই হত্যাকাণ্ড ছিল অভাবনীয় এবং বড় প্রলয়ংকরী ঘটনা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। রাষ্ট্রপতিসহ তিনটি বাড়িতে পাইকারি হারে হত্যাকাণ্ড, রেডিও-টিভি স্টেশন দখল, ট্যাংক মুভমেন্ট, এত বড় ঘটনা ঘটার আগে কেউ টের পেল না, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই জানতে পারেনি- এটা অবিশ্বাস্য। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত পরাশক্তির যোগসাজশেই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের অনেকের ধারণা ১৫ আগস্টের ঘটনায় আমেরিকা মদদ দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটি সবাইকে স্তম্ভিত করেছে।’ কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পরপরই খবরটি জানতে পেরে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ ডেপুটি আর্মি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাকে খবরটি জানানোর পর তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখেননি তারা।

হাফিজ লিখেছেন, ‘কল বেল টিপলে জিয়া নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তার পরনে সাদা পাজামা, সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি, শেভ করছিলেন, মুখে সাদা শেভিং ক্রিম, কাঁধে তোয়ালে। আমাদের দেখে বললেন, হোয়াট হ্যাপেন্ড? ‘স্যার প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড, মেজর রশীদ এসে আমাকে জানিয়ে গেল’ শাফায়াত বললেন। ‘সো হোয়াট? প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, উই উইল আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন’- জিয়ার মন্তব্য।’

জিয়া’র প্রতিক্রিয়ার এই বিবরণ দেওয়া ছাড়া হাফিজ বইতে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও এই বিবরণ থেকে খুবই স্পষ্ট যে, কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে দেশের প্রেসিডেন্ট খুন হওয়ার খবর শোনার পরও সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফের স্বাভাবিক যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা তা একেবারেই দেখা যায়নি, বরং তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য রকম ধীর-স্থির, যেন পরবর্তী করণীয় ঠিক করে রেখে এ খবরটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। হাফিজ লিখেছেন, বছর দেড়েক আগে জিয়া’র পিএস থাকার সময় তিনি তাকে বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কখনো সেনাপ্রধান করবে না। প্রমোশন পেয়ে জিয়া হাফিজকে ফোন করে বলেন,’ তুমি ঠিকই বলেছিলে, শেখ সাহেব কখনো আমাকে চিফ বানাবেন না।’ জনাব হাফিজ বইয়ে একাধিকবার লিখেছেন যে, জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু’র খুনি সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। শাফায়েত জামিল বারবার এ ব্যাপারে জিয়াকে অনুরোধ করলেও জিয়া প্রতিবারই সময় চান। হতাশ হয়ে শাফায়াত নিজেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন। হাফিজ বিষয়টি জিয়াকে জানিয়ে তার সমর্থন চান, কিন্তু জিয়া তাতেও রাজি হননি।

পরবর্তীতে খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া, বিএনপি গঠন, সেনাপ্রধানের পদে থেকেই জিয়া’র রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা, এ পদে থাকাকালে অনেকটা বঙ্গবন্ধুর মতোই নিহত হওয়ার পর দলের হাল ধরা বেগম খালেদা জিয়া’র বঙ্গবন্ধু’র প্রতি কেমন মনোভাব ছিল? এটা জানা যায় বিএনপিরই আরেক নেতা, মরহুম ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা থেকে। এই বইয়ের শিরোনাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম : ২০০৭-২০০৮। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও অনেক রাজনীতিকের মতো মওদুদ আহমদও গ্রেপ্তার হন। বইটি তখন কারাজীবনের ডায়েরি হিসেবে লেখা, যাতে আছে আত্মসমালোচনাও। বইটি শুরু হয়েছে ১০ এপ্রিল ২০০৭ তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার দিন থেকে।

ডায়েরিতে ১৫ আগস্ট ২০০৭ তারিখে তিনি লিখেছেন : ‘সারা দেশে উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী।’... আমার এ কারণে দুঃখ হয় যে, আমার অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি আইনমন্ত্রী ছিলেন) আমি সরকারের বিরোধিতার কারণে আপিল বিভাগে জমে থাকা সেই জঘন্য হত্যা মামলার শুনানি শুরু করতে পারিনি। আমি এমনও যুক্তি দেখিয়েছি যে, মুজিব যখন নিহত হন, তখন বিএনপির জন্মই হয়নি। কাজেই আপিল শুনানি বন্ধ রেখে বিএনপি এর দায়ভার বহন করতে যাবে কেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের আমি তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি লজ্জিত এবং নিজেকেই আমার কাছে ছোট বলে মনে হয়।’ পরের বছরে একই দিনের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন : ‘বিতর্কিত একটি জন্মদিন হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। আমি হলে সঠিক হলেও আমার জন্মদিন এক দিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সব শ্রেণির জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন।’

রেজোয়ান হক, প্রধান সম্পাদক, মাছরাঙা টেলিভিশন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিআইইউ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি কালাম, সম্পাদক রাকিবুল 

অপহরণকালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, নিহত ২

ভারতের ‘ভিত্তিহীন’ দাবির জবাব দিল পাকিস্তানি বাহিনী

দেশীয় অস্ত্রসহ মৎস্যজীবী দলের নেতা গ্রেপ্তার

ভারতের ২৬ ঘাঁটিতে হামলায় করে পাকিস্তান

বৃষ্টি নিয়ে আজও রাজধানীবাসীর জন্য সুসংবাদ 

পাকিস্তানে বিস্ফোরণ, ২ পুলিশ নিহত

আজ বৃষ্টি হতে পারে যেসব জায়গায়

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

শেষ বন্দিকে ছাড়ছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী

১০

গাজায় ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় নিহত আরও ২৬

১১

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১২

১২ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

১২ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

‘যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেনি পাকিস্তান’

১৫

‘আগামী নির্বাচনে জনগণ আ.লীগকে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করবে’

১৬

আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ নেতার মৃত্যু, বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন

১৭

হাসনাতকে অভিবাদন জানালেন সারজিস

১৮

‘ড. ইউনূসের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প’ প্রচারে যা জানা গেল

১৯

যুদ্ধবিরতি বৈঠক / ‘আমি বৃহস্পতিবার তুরস্কে পুতিনের জন্য অপেক্ষা করব’

২০
X