ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৫২ পিএম
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ

তৃতীয় বিশ্বের শাসকরা মস্ত বড় জাদুকর না কি জনগণ আবিষ্ট দর্শক

রাজনৈতিক কাটুন। ছবি : সংগৃহীত
রাজনৈতিক কাটুন। ছবি : সংগৃহীত

একটি জাতির জনগণ চেতনাহীন হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সুবিধা হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতিকরা এই সুযোগটিই নিয়ে থাকে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিবিদরা নিজেদের দেশকে স্থায়ী ঠিকানা ভাবে না। উন্নত বিশ্বের প্রসিদ্ধ সব নাগরী হলো তাদের স্থায়ী ঠিকানা। তাই তারা ছলে-বলে কলে কৌশলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। আর জনগণকে আবিষ্ট করে রাখে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শাসকরা কীভাবে জনগণকে আবিষ্ট করে ফেলে তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাদের সাথে জাদু শিল্পীদের একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জাদু শিল্পীরা জাদুর কৌশলে সাধারণ বা তুচ্ছ জিনিসকে আকর্ষণীয় জিনিস বানিয়ে দর্শকদের করতালি পায়। আসলেই কী তুচ্ছ জিনিসটি আকর্ষণীয় জিনিসে রূপান্তরিত হয়? নিশ্চয়ই না। তাহলে দর্শকরা কেন করতালি দেয়? প্রকৃতপক্ষে, জাদু শিল্পীরা ক্ষণিকের জন্য দর্শকদের দৃষ্টিকে আবিষ্ট করে ফেলে। অন্য কথায়, তাদের চেতনাহীন করে ফেলে। তারা তখন সুকৌশলে লুকায়িত আকর্ষণীয় জিনিসটি বের করে এনে দর্শকদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন তারা তুচ্ছ জিনিসকে আকর্ষণীয় জিনিসে পরিণত করতে সক্ষম। দর্শক যত বেশি আবিষ্ট হয়, জাদু শিল্পীদের জন্য তাদের জাদু দেখানো তত সহজ হয়। আর তাই জাদু শিল্পীরা দর্শকদের কখনো কথার ফুলঝুরি আবার কখনো হাবভাব দিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় আবিষ্ট করতে এক ধরনের পরিবেশ তৈরি করে। জাদু শেষে জাদু শিল্পীরা তাদের পুরো পারিশ্রমিকের সঙ্গে দর্শকের করতালি, ভালোবাসা এবং প্রশংসা নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে। আর অন্যদিকে, নিরীহ দর্শকরা তাদের অর্থ এবং মূল্যবান সময় ব্যয় করে জাদুকরের জাদুর কলা-কৌশলে কাগজ থেকে ফুল, পাখি কিংবা টাকা বানানোর অলীক দৃশ্যের স্মৃতি নিয়ে শূন্য হাতে ঘরে ফেরে, বিনিময়ে পায় সাময়িক বিনোদন। তবুও জাদু শিল্পীরা আবিষ্ট দর্শককের কাছে হিরো হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাদু শিল্পীর মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শাসকরা জনগণের দুর্বল দিকগুলোকে পুঁজি করে তাদের রাজনৈতিক স্লোগান এবং উন্নয়নের কথা মালা সাজায় এবং এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যেন জনগণ আবিষ্ট হয়। জাদু শিল্পীর ক্ষেত্রে জাদুর ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন সহযোগী থাকে যারা তাদের কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি মানুষকে আবিষ্ট করার পরিবেশ তৈরি করে। কখনো কখনো তাদের কাজকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য দর্শককদের মধ্যে থেকেও সহযোগী বাছাই করতে দেখা যায়। শাসকদেরও জাদুর ভেলকি দেখানোর কাজে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সহযোগী থাকে যারা জনগণকে কখনও সামান্য অর্থের লোভ দেখিয়ে আবার কখনো ভয় দেখিয়ে আবিষ্ট করার পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতা করে। দর্শক যত হাবা-গোবা হয় জাদু শিল্পীর ক্ষেত্রে তার জাদুর কারিশমা দেখানো ততটা সহজতর হয়। আবার দর্শকের যদি কাজকর্মের ব্যতিব্যস্ততা কম থাকে তাহলে জাদু শিল্পীদের দর্শক ধরে রাখতে সহজ হয়। তাই জাদু শিল্পীরা সর্বদা হাবা-গোবা এবং কম ব্যতিব্যস্ত দর্শকদের উপস্থিতি কামনা করে। শাসকবর্গের পছন্দের তালিকায়ও হাবা-গোবা এবং কম ব্যতিব্যস্ত বা বেকার লোকজনই বেশি স্থান পায়। কেননা তাদের লোভ বা ভয়ভীতি সহজে দেখানো যায়। সব কালেই এর সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।

তবে জাদু শিল্পীদের তুলনায় শাসকবর্গের বেশ কিছু সুবিধা আছে। যেমন জাদু শিল্পীরা দর্শকরদের হাবা-গোবা এবং কম ব্যতিব্যস্ত বা বেকার বানাতে পারে না। কিন্তু শাসকদের নিকট জনগণকে হাবা-গোবা এবং কম ব্যতিব্যস্ত বা বেকার বানানোর যথেষ্ট উপায় এবং উপকরণ ও ক্ষমতা আছে। আর তাদের এগুলোর ব্যবহার করতেও দেখা যায়। জাদু শিল্পীরা আবার দর্শকদের বিভিন্ন দলে বা উপদলে বিভাজিত করতে পারে না, যদিও সেটির প্রয়োজনও নেই। কিন্তু শাসকবর্গের নিকট এমন উপায় এবং উপকরণ আছে যা দিয়ে জনগণকে সুকৌশলে নানা দলে এবং উপদলে বিভাজিত করে। আর এ বিভাজন জনগণকে আবিষ্ট বা চেতনাহীন করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহযোগিতা করে।

জাদু শিল্পীর জাদুর কৌশলের সাথে শাসকরা জাদুর ভেল্কির আরও পার্থক্য আছে। যেমন জাদু শিল্পীর জাদুর আবিষ্টতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, কেবল জাদুর প্রদর্শনী চলাকালীন তা স্থায়ী হয়। তবে, শাসকবর্গের জাদুর ভেল্কির আবিষ্টতা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ যেন পৌরাণিক কাহিনিকেও হার মানায়। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে অনেক সময় দেখা যায়, জাদুকর স্থায়ীভাবে তার শিকারকে স্ট্যাচু বা পাথরে পরিণত করে ফেলে। তৃতীয় বিশ্বের শাসকরা হয়তো সেই কলাকৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছে। এখানে উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমারের উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই তারা জনগণকে সম্পূর্ণ আবিষ্ট বা চেতনাহীন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে পৌরাণিক কাহিনিতে স্ট্যাচু বা পাথরে পরিণত হওয়া জনগণকে উদ্ধারের জন্য কোনো ঋষি, নিষ্পাপ রাজপুত্র বা নায়কের আবির্ভাব দেখা যায়- যার ছোঁয়ায় জাদুর প্রভাব কাটিয়ে জনগণ সাধারণ অবস্থায় ফিরতে পারে। কিন্তু শাসকদের জাদুর ভেল্কিতে আবিষ্ট জনগণকে উদ্ধারের জন্য কোনো ঋষি, নিষ্পাপ রাজপুত্র বা নায়কের উপস্থিতি এখনকার দিনে চোখে পড়ে না। তবে আবিষ্টদের চেতনা ফেরানোর উপায় কি? এ ক্ষেত্রে বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। তবুও আশা করি, যেসব নিষ্পাপ যুবক এবং তরুণরা এখনো আবিষ্ট হয়নি তাদের তেজোদীপ্ততায় যারা সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে গেছে তাদের চেতনা হয়তো একদিন ফিরবে। আর তা না হলে শাসকরা পৌরাণিক কাহিনির মহাজাদুকরের মতো জনগণকে সম্পূর্ণ অচেতন করে তাদের পারিশ্রমিকের ষোলোকলা পূর্ণ করবে, পাশাপাশি পাবে আবিষ্টদের করতালি এবং প্রশংসা। আর কখনো কোনো অলৌকিক কারণে এসব জাতির চেতনা ফিরলে দেখবে রিক্ত, নিঃস্ব এবং ঋণের জালে আবদ্ধ একটি অর্ধ-স্বাধীন ধূসর ভূখণ্ড।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যাকে নিয়ে প্রেমের গুঞ্জন, তার সঙ্গেই সামান্থা 

গাড়ির ধাক্কায় উত্তরার সড়কে মাছ ব্যবসায়ী নিহত

১৬ মাস পর পাবনায় গেলেন রাষ্ট্রপতি

আসছে টানা ৩ দিনের ছুটি

ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ, খালু গ্রেপ্তার

ফের ৩ দাবিতে শহীদ মিনারে প্রাথমিকের শিক্ষকরা

ঝাড়খণ্ড / ব্লাড ব্যাংকের রক্ত নিয়ে এইচআইভি আক্রান্ত ৫ শিশু

আইসিসির সভায় এশিয়া কাপের ট্রফি হস্তান্তর নিয়ে যা হলো

তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড

অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেল বাংলাদেশ

১০

‘ধানের শীষ রেকর্ড সংখ্যক ভোটে বিজয়ী হবে’

১১

নাসির গ্রুপে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

১২

মেঘলা থাকবে ঢাকার আকাশ, কমবে তাপমাত্রা

১৩

মঞ্জুরুল ও জ্যোতিকে নিয়ে এবার বিস্ফোরক মন্তব্য আরেক নারী ক্রিকেটারের

১৪

জেনে নিন আজকের স্বর্ণের বাজারদর

১৫

সন্ত্রাসী ‘বুইস্যার’ সহযোগী ইয়াছিন অস্ত্রসহ ধরা

১৬

যে কারণে এসএ টোয়েন্টিতে খেলা হচ্ছে না তাইজুলের

১৭

শিগগিরই গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন: ট্রাম্প

১৮

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধানক্ষেতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে সংঘর্ষ, আহত ১৫

১৯

যৌন হয়রানির অভিযোগ: সবার প্রতি যে অনুরোধ করলেন মঞ্জুরুল

২০
X