ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:১৩ পিএম
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৪৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

স্মৃতির আয়নায় একাত্তরের যুদ্ধ ও বিজয় দিবস

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। ছবি : লেখকের সৌজন্যে
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমি কুমিল্লায় ছিলাম। সে রাতে আমাদের সাধ্যমতো প্রতিরোধ সত্ত্বেও শুধু ক্যান্টনমেন্টের নৈকট্যের কারণে কুমিল্লার স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারিনি। সেনানিবাস থেকে বের হয়ে এসে পাকিস্তানি হানাদাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালায় ও পুলিশ লাইন্সে সুপরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে কুমিল্লার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। কুমিল্লা বিমানবন্দরে পর দিন থেকেই কমান্ডো নামতে শুরু করে। তারা বিমানবন্দরের আশপাশের গ্রামগুলোতে বোমা ও গুলিবর্ষণ করে ত্রাস ও হত্যার রাজত্ব কায়েম করে। তবুও আশপাশের এলাকাগুলোতে সংঘঠিত হয়ে পুলিশ, তদানীন্তন ইপিআর ও আনসারের সহায়তায় ৭ এপ্রিল পর্যন্ত কুমিল্লা শত্রুমুক্ত করার প্রচেষ্টায় আমরা অনেকেই জড়িত ছিলাম।

৭ এপ্রিল গোমতী নদী পার হয়ে ভারতের দিকে রওয়ানা হলাম। পথে সৈয়দ রেজাউর রহমান, রশিদ, রুস্তম, পাখীসহ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের পেছনে রেখে আমি, কাশেম ও অপরাপর কয়েকজন ভারতীয় সীমান্তে গিয়ে সীমান্তের অপর পাড়ে পা রাখতে দ্বিধান্বিত ছিলাম। পাকিস্তান আমাদের মগজ এমনভাবে ধোলাই করেছিল, আমরা ভাবতাম ভারত মানে হিন্দুর দেশ, হিন্দু মানে রাক্ষস-খোক্কস, সামনে গেলেই গিলে খাবে বা রায়ট করে মেরে-কেটে শেষ করে দেবে। কম্পমান পা ফেলে দুরু দুরু বুকে সীমান্ত অতিক্রম করলাম। তারপর থেকে ভিন্ন জীবন। বহুদিন চলে গেল। আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন বোঝা গেল, যুদ্ধে যৌথ কমান্ডো গঠিত হচ্ছে তখন আমাদের অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণি মুজিব বাহিনীকে দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের একটি এলাকা দখল করে সেখানে মুজিব নগর সরকারকে নিয়ে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সে মোতাবেক শীর্ষস্থানীয় ও সুশিক্ষিত এক বাহিনী নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের সিদ্ধান্ত হয়। এই অভিযানে যেতে আমি জেদ ধরে বসি। মণি ভাই প্রথমে আমাকে নিতে নারাজ ছিলেন। তার কতিপয় অকাট্য যুক্তি ছিল। তর্ক-বিতর্ক শেষে তিনি একটি যুক্তিতে আমাকে ঘায়েল করলেন। আমাকে সেক্টরের দায়িত্ব ও যৌথ কমান্ডো গঠিত হলে তাতে মুজিব বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করার নির্দেশ দিয়ে গেলেন।

মুষ্টিমেয় কিছু যোদ্ধা ও সহযোগী নিয়ে আমি আগরতলা গ্লাস ফ্যাক্টরির বেস ক্যাম্পে রুটিন কাজ করতে লাগলাম। ডিসেম্বরের দুই তারিখ পাকিস্তানি সেভর জেট ফাইটার আগরতলায় আঘাত হানে। হয়তো মুজিব বাহিনীর প্রধান কার্যালয় গ্লাস ফ্যাক্টরি তাদের টার্গেট ছিল কিংবা যুদ্ধ বাধাবার মতলবে খামাখাই বোমাবাজি করল। দায়িত্বপ্রাপ্ত আমি সবাইকে নিয়ে বিমানাঘাত থেকে রক্ষার পথ খুঁজতে থাকি। ওই দিনই ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিটি পুনর্জীবিত করা হয়। আশঙ্কায় বুক টিপ টিপ করতে থাকে।

ডিসেম্বরের তিন তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি আসন্ন জরুরি অবস্থার ইঙ্গিত দেন। তিনি শেখ মুজিবকে আপন ভাই এবং বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই পাকিস্তান দিল্লিতে বিমান হামলা দিয়ে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের সূচনা করে। মিসেস গান্ধী দিল্লি ফেরার আগেই ভারতীয় বিমানবাহিনী করাচি, লাহোরসহ পাকিস্তানের অনেকগুলো শহরে পালটা হামলা চালায়।

ডিসেম্বরে দুই-তিন তারিখে একটি যুদ্ধবিরতির জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে চার তারিখ তা শান্তি পরিষদে উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো প্রদান করে। সেদিন থেকে ৯ বার ভেটো প্রদান না করলে এক ধরনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়ে আমাদের বিজয় অনিশ্চিত হয়ে যেত।

ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে যৌথ কমান্ডোর ঘোষণা চূড়ান্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের কৌশল পালটে গেল। গেরিলা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেল। তখন কামান কামানকে, ট্যাংক ট্যাংককে আর বিমান বহরকে বিমানবহর আঘাত করছে। মাটি কাঁপিয়ে, কান ফাটিয়ে ও চেতনায় চিড় ঘটিয়ে শক্তিশালী কামান ও ট্যাংক গর্জে উঠল। গেরিলা যোদ্ধাদের দায়-দায়িত্ব বদলে গেল। তারা তখনও যৌথ কমান্ডের চোখ, কান ও মাথা। কুমিল্লার অদূরে কাঠালিয়ার কাছে স্মরণাতীত কালের ট্যাংক লড়াইয়ে পাকিস্তান বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পিছু হঠে গেল। একইভাবে বিবির বাজার, সালদা নদী ও আখাউড়ার ব্যাংকারগুলো গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হলে পাকিস্তান বাহিনী পশ্চাৎমুখী হলো। আমাদের গেরিলা ইউনিটগুলোর বেশ কটিই সীমান্ত এলাকায় ছিল। তারা যেন কামান, ট্যাংক ও বিমানের খোরাক হয়ে না যায় তা দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। চার তারিখে আখাউড়া ও পাঁচ তারিখে বিবির বাজার দিয়ে কুমিল্লা ঢোকার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আমার হাতের আমেরিকান পিস্তল ও যুগোস্লাভিয়ার রিভলভারকে নেহায়েত খেলনাসামগ্রী মনে হলো।

ভারতীয় বাহিনীর দুয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার পরিচয় জেনে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তবুও ছয় তারিখে গোলাগুলির ফাঁক দিয়ে কুমিল্লার কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বিজয় সন্নিকটে। ছয় তারিখে শহরের প্রায় চার মাইল দক্ষিণে এক গ্রাম পার হতে গিয়ে শুনলাম মা সে গ্রামে আছে। আমার বাবা আমার ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় অসহায় মা আমাকে ধরেই বেঁচেছিলেন। তার আশা ছিল, আমি তার মুখোজ্জ্বল করব। তাই মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়াটাতে তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। এটা অস্বাভাবিকও ছিল না। কারণ আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত এবং বিদেশে পড়ার একটি বৃত্তি বলতে গেলে আমার হাতে। একটা শঠতার আশ্রয় নিয়ে ভারতে চলে যাই।

ইতোমধ্যে মা জেনেছে তার ছেলে নিখোঁজ। একবার মামা আমাকে দেখে গিয়ে মাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তবে লোকমুখে অশুভ সংবাদও যে শুনেনি তা নয়। আমি গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। ভাবছি মা আমাকে জড়িয়ে ধরবে, বুকে টেনে নেবে। অনেকগুলো সশস্ত্র লোক দেখে হয়তো তিনি ঘাবড়ে গেলেন। আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন কি না বুঝলাম না। তার উদাস দৃষ্টি ভাবান্তরবিহীন। মুখে উচ্চারণ করলেন ‘দেশের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহই রক্ষা করবে।’

যুদ্ধ কবে শেষ হবে তিনি জানতে চাইলেন। আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারলাম না। দ্রুত সে জায়গা ছেড়ে এলাম। সাত তারিখেও দক্ষিণ দিক দিয়ে শহরে ঢোকার উপায় ছিল না। তখনও রাজাকার ও পাকিস্তানিরা ভাবছে ভিন্ন কথা। আট তারিখে প্রচণ্ড শেলের আঘাতে শত্রু পক্ষ বিমানবন্দর এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করল। সেদিনই কয়েকবার গ্রামের পাশাপাশি গিয়ে আবার ফিরে আসলাম। বড্ড ইচ্ছা হলো আমাদের বাড়িটা দেখার। স্থল মাইনের ভয়ে আর যেতে পারলাম না, সারাটা গ্রামে তখনও কোনো জনপ্রাণীর সাড়া ছিল না। সাত তারিখেই কেউ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে আবার কেউবা শহরের দিকে যাচ্ছে।

শেষের দিকে গ্রাম অপেক্ষা শহরকে বরং মানুষের বেশি নিরাপদ মনে হতো। তবে শহরগুলোতে গুপ্ত হত্যার নীলনকশা সম্পর্কে আমাদের একটা অগ্রিম ধারণা ছিল। তাই আট তারিখে কুমিল্লা শহর মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গুপ্ত হত্যা, লুটতরাজ বা দালাল ধরে টাকাপয়সা আদায়ের পথগুলো বন্ধ করতে তৎপর হলাম। শহরের প্রবেশ পথগুলোতে আমাদের ছেলেদের দিয়ে চেকপোস্ট বসানো হলো। আমি, তাহের, রুস্তম, পাখী, আলী ইমাম, কেনু ভাই, হিরন, কাশেম ও সেলিমসহ অনেককে নিয়ে চেকপোস্টগুলো পরিদর্শন করতাম। সেনানিবাসকে ঘিরে থাকা আমাদের গেরিলা ইউনিটগুলোকে রাতে দেখতে যেতাম। একদিন নিজেদের বাহিনীর অ্যামবুশে নিজেরা পড়ে গিয়ে প্রায় শেষ হবার জোগার হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গেও দুয়েক জায়গায় ভুল বোঝাবুঝির সূচনা হলো।

মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা যখন শহরে ঢুকলো তখন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে তাদের দেখার জন্যে মানুষের ঢল রাস্তায় নামল। মানুষের ভালোবাসা ও ঘৃণা যে কত গভীর হয় তা এই যুদ্ধে দেখলাম। দোকানগুলোতে ভারতীয় মুদ্রায় কেনাবেচা শুরু হলো। আট তারিখে সিভিল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হলো। তখন থানাতে বা পুলিশ লাইন্সে পুলিশ ছিল না। ভয়ে ভয়ে সরকারি কর্মচারীরা গৃহে অবস্থান নিল। প্রশাসন না থাকলেও চুরি-ডাকাতি দেখা গেল না। আমরা কুমিল্লার রাজবাড়িতে আমাদের সহযোগী ভারতীয় ইউনিটটির অফিসের ব্যবস্থা করলাম ও নিজেরা আকবর-কবিরদের বাড়িতে অফিস স্থাপন করলাম। এখানে টেলিফোনের অফিসে অনবরত লোকজন আসতে লাগল। চলাচলের জন্যে পাস ইস্যুর প্রয়োজন ছিল। কবির কোনো এক প্রেস থেকে আমার নামে একটি প্যাড ছাপিয়ে আনল। সে প্যাডে বিভিন্ন নির্দেশ, পরামর্শ বা চলাচলের হুকুম দিতে শুরু করলাম। আসলে এভাবে একটা সিভিল প্রশাসন নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা হলো।

আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাডভোকেট আহমদ আলীকে সিভিল প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িত ছিলেন না বলে সশস্ত্র ব্যক্তিদের সামলিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা তার জন্যে দুষ্কর হলো। তিনি আমাকে সঙ্গে নিলেন। কুমিল্লায় আমি খুব পরিচিত না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল। প্রশাসনের লোকরা শ্রেণি-নৈকট্যের কারণে আমার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া পছন্দ করতেন। কয়েক দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসনের সব ধরনের কর্মচারীদের এক সভায় আমি ও আহমদ আলী সাহেব ভাষণ দিলাম। আমাদের মতো করে স্বাধীন দেশে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব কী তা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখলাম। বিস্তারিত দায়দায়িত্ব তখন সবাইকে বুঝাতে পারিনি বলে সেদিন থেকে তাদের কাছ থেকে অনবরত টেলিফোন কল পেতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ির পুকুরপাড়ে আকবর-কবিরদের বাসাটি প্রশাসনিক সদর দপ্তরে পরিণত হলো। সাত ডিসেম্বর ইয়াহিয়া নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের সাধের পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব জনমত অনুকূলে নেওয়ার প্রয়াসে তারা ঢাকার ইসলামিয়া এতিমখানায় বোমাবাজি করে কয়েকশ এতিম শিশু হত্যা করে। সাত ডিসেম্বর যশোর ও আট ডিসেম্বর কুমিল্লার পতন ঘটে। কুমিল্লায় পাকিস্তান বাহিনী সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান নেয়।

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং ভুটানও সে পথ অনুসরণ করে। ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের মুখ ভারত মহাদেশের দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের বাহানায় বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের ইচ্ছে প্রকাশ করে। পাকিস্তানিদের মনোবল রক্ষার আর এক উপায় হিসেবে উত্তর থেকে চীন এবং দক্ষিণ থেকে সপ্তম নৌবহরের অগ্রযাত্রার কথা শুনতে থাকি। তবে স্থল যুদ্ধে পাকিস্তান কোথাও দাঁড়াতে পারছিল না। যশোর পতনের পরই সিলেটে যৌথবাহিনীর যোদ্ধারা হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ শুরু করে।

যশোর পতনের পরই লে. জে. নিয়াজি বুঝে নেয় যে পতন আসন্ন। সে কারণে গভর্নর মালেকের মাধ্যমে সে বিদেশি সাহায্য ও পরামর্শ চেয়ে পাঠায়। ১০ ডিসেম্বর চাঁদপুর ও দাউদকান্দির পতন ঘটে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে সরে পাকিস্তান আর্মি ঢাকামুখী হতে শুরু করে। কিন্তু তারা যেন ঢাকায় গেড়ে না বসতে পারে এ জন্য যৌথবাহিনী বিমান আক্রমণ দ্বারা নিয়াজিকে অস্থির করে তুলে। হঠাৎ করে নিয়াজি নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে ১০ তারিখে তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দেখা যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

ইতোমধ্যে এন্টারপ্রাইজ নামক নৌবহর মোকাবিলা করতে সোভিয়েত নৌবাহিনী ও ভারতীয় নৌবাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রাম ও খুলনার দিকে আগাতে চায়, যা যৌথবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রতিহত করে। মিথ্যা আশ্বাসে প্রলুব্ধ না হয়ে নিয়াজি আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। তবে কোনোভাবে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। ১৩ ডিসেম্বর জেনারেল শ্যাম মানেক শয়ের নামে ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অস্ত্র সমর্পণের আবেদন জানানো হয় ও আত্মসমর্পণকারীদের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর থেকে ব্যাপক হারে রাজাকার-আলবদর ও আলশামসরা বুদ্ধিজীবী হত্যা কর্ম চালাতে থাকে। ওই দিনই বঙ্গভবনে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য সমবেত করা হবে জেনে ভারতীয় বিমানবাহিনী বঙ্গভবন ও কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় বিমান আক্রমণ চালায়। গভর্নর মানেক পদত্যাগ করে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ভীত ও হতভম্ব নিয়াজি মার্কিন দূতাবাসে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ সফল করার প্রস্তাব দেয়।

১৪ তারিখে বলতে গেলে কতিপয় সেনানিবাস ও মিরপুর ছাড়া সারা বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়। তখনও মোশতাক গং পাকিস্তান রক্ষায় শেষ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। অতিশয় ন্যক্কারজনক শর্তাবলি সংবলিত আত্নসমর্পণ দলিল পাকিস্তান অনুমোদন দিলে ১৬ ডিসেম্বর বিকালে আত্মসমর্পণের ৭ দলিল স্বাক্ষরিত হয়। কলকাতায় খোঁজাখুঁজি করে গ্রম্নপ-ক্যাপ্টেন খোন্দকারকে পাওয়া গেলে তিনি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে ঢাকামুখী বিমানে সওয়ার হন। ৯৩০০০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সকলেই যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করে। আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হলেও বিজয়টা পূর্ণতা লাভ করল না আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম কবে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন, কবে বঙ্গমাতাসহ শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল বন্দিদশা থেকে উদ্ধার হবে, আর কবে মিরপুরের বিহারিরা আত্মসমর্পণ করবে। এই পুরো সময়টায় আমি কুমিল্লাতেই ছিলাম। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত সারা দেশে এক ধরনের স্বস্তিবোধ আসে। তারপরও আমরা মিরপুর নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে উৎকণ্ঠিত জীবন কাটাতে থাকি।

বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়েও আমাদের উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। ১৭ আগস্ট মেজর তারার নেতৃত্বে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাদের অবরোধ থেকে নিষ্কৃতি পান। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পরই আমরা বিজয়ের আসল স্বাদটি অনুভব করি। জেনারেল ওসমানী ও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ আমি স্বচক্ষে দেখেছি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কিছু আগে ওসমানী হেলিকপ্টারে চড়ে বসেছিলেন। তার সঙ্গে শেখ কামাল ছিলেন। শেখ কামাল ছিলেন তার এ ডি সি। আমার সঙ্গে জেনারেল ওসমানীর তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল না। যুদ্ধের সময়ে কালে-ভদ্রে তার সঙ্গে দেখা হলেও আমাকে চিনে রাখা বা মনে রাখার মতো পরিচয় ছিল না। তবে কামালের সঙ্গে আমার শুধু পরিচয় নয়, ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি কামালের কাছে ছিলাম তার মান্নান ভাই। কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ১৬ ডিসেম্বর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত এক মহাসমাবেশ দেখেছি। বাঘা বাঘা যোদ্ধারা সেখানে আসছেন। সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি গেরিলা যোদ্ধা এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেনেই আমাকে সার্কিট হাউসে আসতে দেওয়া হলো। আত্মসমর্পণের দিন আমি দেখলাম, সার্কিট হাউসের কাছাকাছি জায়গায় জেনারেল ওসমানী ও কামাল হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করলেন। তারা এখানে বেশিক্ষণ ছিলেন না। কাছে গিয়ে আমি জেনারেল ওসমানীকে তার বাহিনীর অনেক সদস্যের মতো চাচা বলে সম্বোধন করলাম এবং তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কি না তা জানতে চাইলাম। তিনি এ প্রশ্নের কোনো সরাসরি জবাব দেননি বরং দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠে যান।

সেদিন থেকে অনেকের ন্যায় আমিও একটি খুঁতখুঁতানি নিয়ে ছিলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দীর্ঘদিন সদস্য ছিলাম। সে সিনেটে কার্যবিবরণী এখনও সহজ প্রাপ্য। জেনারেল ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এলেন না সে প্রসঙ্গটি একবার উত্থাপিত হলে আমি আলোচনায় অংশ নেই। আমার বক্তব্যটি তুলে ধরার আগে যৌথ কমান্ড গঠনের শানে-নুজুল তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকেই ভারতীয় বাহিনী আমাদের বাংলাদেশের সবকটি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছিল। কৌশলগত কারণে তা সোচ্চার প্রকাশের সুযোগ ছিল না।

মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা ভিয়েতনামের মতো আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু দিনে দিনে অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। পাকিস্তানিদের চাপ হোক, অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ কিংবা কূটকৌশলে মুক্তিযোদ্ধারাসহ গণপ্রতিনিধিদের যুদ্ধের পক্ষে পরিবর্তনের একটা প্রবণতা হলো। ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যোদ্ধাদের সুদৃঢ় ঐক্যে কিছুটা হলেও ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মোশতাক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝোতার উদগ্র কামনা ও প্রয়াস। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সংকট প্রবল হয়ে উঠেছিল। অসুখবিসুখও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৃষ্টি, রোগ শোকে, অনাহারে, অর্ধাহারে সংকট দিনে দিনে প্রবলতর হচ্ছিল। শিবিরগুলোতে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হচ্ছিল, যোদ্ধাদের মধ্যে ব্যর্থতার গ্লানি প্রকট হচ্ছিল। মনোবল ভেঙে তারা ধৈর্যহারা হয়ে উঠছিল এবং ভারতের হস্তক্ষেপের দাবি বেশি বেশি উঠেছিল। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ও ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের দাবিও সোচ্চার হচ্ছিল। দেশের অভ্যন্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশার আভাস মিলছিল। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষত আমাদের অধৈর্যশীলতার কথা জেনেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব ভিয়েতনাম কায়দায় দেশ স্বাধীনের ভাবনা ছেড়ে ভারতের সাথে যৌথ প্রয়াসে দেশ স্বাধীনে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। যৌথবাহিনী গঠিত হলে উভয় পক্ষের দুই সেনাপতির পদমর্যাদা এক হতে হয়। তাই আগে থেকেই কর্নেল ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ভারতের পুরো বাহিনীর সাথে আমাদের যৌথ কমান্ড গঠিত হয়েছিল।

বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল ওসমানীর সমকক্ষ অর্থাৎ কাউন্টার পার্ট ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর শ্যাম মানেকশ। প্রটোকল অনুসারে শ্যামের সাথে ওসমানী বসতে পারেন কিন্তু জগজিৎ সিং অরোরার উপস্থিতিতে কেবল মাত্র আমাদের উপপ্রধান এ কে খোন্দকারই বসতে পারেন। ওসমানীর উপস্থিতিটা হতো আমাদের জন্য চরম অবমাননাকর ও সামরিক প্রটোকল বহির্ভূত। তাই উপপ্রধানের সাথে উপপ্রধানের সমতা বিধানের জন্যই ওসমানী সাহেব পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, ছিলেন খোন্দকার সাহেব। আমার এই ব্যাখ্যাটি বিনা বাক্য ব্যয়ে সিনেট অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল। আমি দিন তারিখটি বলতে পারব না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশনের কার্যবিবরণী অনুসন্ধানে তা পাওয়া যাবে। আমি এই ব্যাখ্যাটি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে একাধিকবার দিয়েছি এবং সবাই আমার ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেছেন বলে আমার মনে হয়েছিল। জেনারেল ওসমানীর কাছে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পাকিস্তানিদের চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণা ছিল বলে পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনী অপেক্ষা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত ছিল। তদুপরি জগজিৎ সিং অরোরা ও জেনারেল নিয়াজি ছিল কোর্সমেট এবং ব্যক্তিগত বা সমষ্টি নিরাপত্তা ও অহমবোধ বাঁচিয়ে রাখতে অরোরার কাছে নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হলো। বাংলাদেশ বাহিনীর জেনেভা কনভেনশনে কোনো পক্ষ ছিল না।

পাকিস্তানিরা জানত, বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। যৌথবাহিনী চাচ্ছিল যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি কেননা তখন সপ্তম নৌবহর আসে আসে অবস্থা। তাই অনেকটা পাকিস্তানিদের চাপে পড়েই অরোরার কাছেই আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা পাকা হয় এবং পাকিস্তানি পক্ষে নিয়াজি স্বাক্ষর দান করেন।

লেখক : ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেরাদুনে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘৩০ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখলে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়’

রাতের মধ্যে ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

যুবলীগ নেতাকে ছাত্রলীগের আল্টিমেটাম

সতর্ক করল বিমান মন্ত্রণালয়

ভাসানীর আদর্শে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে : জাগপা

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নেবে ল্যাবএইড, ৪৫ বছরেও আবেদন

নির্বাচন কমিশন একদিন বিশ্বের রোল মডেল হবে : ইসি হাবিব

হবিগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ

২৫০ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা

‘কোরবানিতে চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ পশু বেশি আছে’

১০

যুবলীগ নেতাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পাঠান হলো হাসপাতালে

১১

সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়েছে

১২

ঈদ উপলক্ষে ওয়ালটনের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পণ্য উন্মোচন

১৩

বিদ্যুৎস্পর্শে যুবকের মৃত্যু

১৪

বাসে জাবি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় মহিলা পরিষদের বিবৃতি

১৫

পুলিশের গাড়িতে গুলি করা ডাকাত সর্দার গ্রেপ্তার

১৬

এসএসসি পাসে ওয়ালটনে নিয়োগ, বয়স ২০ হলেই আবেদন

১৭

নিপুন তো বাপকেই অস্বীকার করছে : ডিপজল

১৮

২১ মে যেসব এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা

১৯

জলবায়ু পরিবর্তনে ১৪ গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরা : পরিবেশমন্ত্রী

২০
X