আবুল হাসান, গাজীপুর
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ০৩:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

গাজীপুরে এক বছরে বন্ধ ১০৬ কারখানা, অপরাধে জড়াচ্ছেন বেকার শ্রমিকরা

গাজীপুরে বন্ধ একটি কারখানার চিত্র। ছবি : কালবেলা
গাজীপুরে বন্ধ একটি কারখানার চিত্র। ছবি : কালবেলা

জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতে অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল, ঘন ঘন শ্রমিকদের আন্দোলন, ভাঙচুরসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে গাজীপুরে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক তৈরি পোশাক কারখানা। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন লাখো শ্রমিক। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিকসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতে।

পুলিশ বলছে, বিপুল শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায় অনেকেই অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছেন।

কারখানা মালিক ও বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতারা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসন ও দ্রুত ব্যাংকের সহজ ঋণ সুবিধা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরে কোনাবাড়ি জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপ। এই কারখানায় কাজ করতেন ১৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে প্রতিষ্ঠানে প্রথম মন্দার ধাক্কা লাগে ২০২৩ সালে। পরে রাজনৈতিক ও ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কারখানাটির একের পর এক ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়।

ঋণখেলাপির অভিযোগ এনে কারখানা মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। মালিকপক্ষের কোনো আবেদনেই সাড়া দেয়নি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস-বিদ্যু্ৎ বিলসহ কারখানা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে তীব্র সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরে ঘন ঘন শ্রমিকদের আন্দোলন, ভাঙচুরের ঘটনায় কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

কেয়া গ্রুপের মালিকপক্ষের দাবি, ব্যাংকের অসহযোগিতায় কারণে ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে যে ফরেন কারেন্সি এসেছে তা ডিপোজিট করা হয়নি। ফলে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকগুলো ফরেন কারেন্সি পুরোপুরি ডিপোজিট করলে কারখানা ঋণখেলাপি হতো না।

এ ব্যাপারে কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান বলেন, সাউথ ইস্ট ব্যাংক আমার এক হাজার মিলিয়ন রিয়েলাইজ পেয়েছে কিন্তু তারা আমার ফরেন কারেন্সিতে ৬শ মিলিয়ন ঢুকাইছে এবং ৪শ মিলিয়ন তারা ডিপোজিট করেনি, যার জন্য একটি প্রবলেম। পূবালী ব্যাংক দুইশ মিলিয়ন রিয়েলাইজ হয়েছে, তারা ফরেন কারেন্সিতে কোনো ডিপোজিট করেনি।

ন্যাশনাল ব্যাংক ৫৮ মিলিয়ন এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৬ মিলিয়ন ডিপোজিট করেনি। এ চারটি ব্যাংকে আমার ঋণ ২৬০০ কোটি টাকা। তারা যদি ফরেন কারেন্সি ঢোকায় তবে সমস্যা থাকে না। এ ছাড়া কারখানায় গ্যাস সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি।

কারখানা বন্ধ ঘোষণা করায় কর্মহীন হয়ে পড়েন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। কর্মচাঞ্চল্যের এ প্রতিষ্ঠানটি রূপ নেয় প্রাণহীন।

কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত গাজীপুরের ১০৬টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে নিজ নিজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে বেকার হয়েছেন ৭৮ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।

কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্ল্যাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলস, টি আর জেড গার্মেন্টস, রোয়া ফ্যাশনসসহ বিজিএমইএভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, বেকার এসব শ্রমিক অনেকে কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। চাকরি ছেড়ে অটোরিকশা চালনা, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। নারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকে অন্যত্র গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন।

অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ গাজীপুরে থেকে টেইলারিং, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরে শ্রমিকপল্লিতে চলছে হাহাকার। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এ ব্যাপারে টি আর জেড গার্মেন্টস শ্রমিক সালেহা বেগম বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর এই কারখানায় কাজ করছি। এখন কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে আছি। নতুন কারখানায় যোগ দিতে পারিনি। আগের মতো সুযোগ-সুবিধা না পেলে চাকরি করে কী হবে।

এদিকে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া এবং বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তারা ভাঙচুর, বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটান। এতে প্রায় সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা।

শুধু শ্রমিক নয়, কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। কারখানা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি ভাড়াসহ নানা ক্ষুদ্র পেশায় ধস নেমেছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া বাসা বদল করে অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়েছেন অনেকে।

কেয়া গ্রুপের সামনে কথা হয় কয়েকজন দোকানির সঙ্গে। তারা বলেন, আগে আমাদের দিনে ১২-১৫ হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। এখন এক হাজার-১৫শ টাকা বিক্রি হচ্ছে। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে পরিবার নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

জরুন এলাকার মুদি দোকানি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আগে প্রতিদিন দোকানে ১০ -১৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো এখন সেটি ১-২ হাজারে নেমে এসেছে। এলাকায় আগের মতো বেচাকেনা নেই।

গাছা এলাকার বাড়িওয়ালা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক সময় বাসা ভাড়ার জন্য প্রতিদিন লোক আসতেন। এখন ভাড়াটিয়ার চাপ কমে গেছে। অনেকের বাসা খালিও থাকছে। এ অবস্থায় বাড়িতে বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে সমস্যা হচ্ছে।’

বিজিএমইএ ও পোশাক কারখানা মালিকরা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসনের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও কারখানা চালুর বিষয়ে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে এসি শিল্প এস্টেট ও স্টাইলিশ গার্মেন্টস চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকের সহযোগিতা পাচ্ছেন না মালিকরা। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে, বেকার হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা। অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। এটা অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। ব্যাংক সহায়তা, পোর্ট সুবিধাসহ এক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন।’

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) মো. রবিউল ইসলাম বাঁধন জানান, দেশের পোশাক কারখানাগুলো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। অধিদপ্তর কারখানা বন্ধের সঠিক কারণ নির্ণয় ও কারখানা চালু করতে করণীয় বিষয়ে কাজ করছে।

এদিকে, তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর গাজীপুরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার শ্রমিকশ্রেণি যাদের পেটে ভাত বা খাবার জোগান করতে পারেনি, তারা রাস্তায় বেরিয়ে ছিনতাই বা অন্য অপরাধে জড়িয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে যে কোনো জায়গায় অপরাধ বেড়ে যায় এটা স্বাভাবিক। কারখানা বন্ধ হওয়াটাকে আমরা হুমকি মনে করছি। বেকার শ্রমিকদের একটি অংশ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে।’

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার বলেন, ‘মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংক ঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশিরভাগ কারখানা।’

মালিক-শ্রমিক ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড় ৫ হাজার কলকারখানা রয়েছে যার মধ্যে দুই হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা। এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা এক হাজার ১৫৪টি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মুক্তির দিনেই পাইরেসির কবলে ‘ওয়ার-২’

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের চুক্তির মেয়াদ বাড়ল

আইনি ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে হবে : খেলাফত মজলিস

যাদের হজে নেওয়া যাবে না, জানালেন ধর্ম উপদেষ্টা

সালাহউদ্দিন কাদেরের ফাঁসি, জুডিসিয়াল মার্ডার : হুম্মাম

পদ্মার পানি বিপৎসীমায়, প্লাবিত নিম্নাঞ্চল

পাথর লুট : পরকালে দেওয়া হবে যে ভয়াবহ শাস্তি

দুই সন্তানের বাবাকে শিশু দেখিয়ে জামিনে মুক্তি

রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে হাসিনাসহ ২৮৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

রাজধানীতে ফানুস ওড়ানোতে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা

১০

বাইডেনের ছেলেকে মামলার হুমকি দিলেন ট্রাম্পের স্ত্রী

১১

দীর্ঘ বিরতির পর ফিরছেন রুবেল

১২

মেঘনায় ১৮ হাজার বস্তা সিমেন্টসহ ডুবল লাইটার জাহাজ

১৩

প্রতারণার অভিযোগে ফের বিপাকে রাজ-শিল্পা

১৪

ক্লাব বিশ্বকাপের বোনাসের অংশ জোতার পরিবারকে দেবে চেলসি

১৫

জবির নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে মেডিকেল কার্যক্রম চালুর আবেদন

১৬

যারা নির্বাচন করবেন, তারা কেন সরকারে : রাশেদ খান

১৭

বঙ্গতে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’

১৮

সরকারি চাকরিজীবীদের ৪২ ধরনের আয় করমুক্ত

১৯

সুপার কাপ ফাইনালে ফিলিস্তিনি শিশুদের পক্ষে উয়েফার ব্যানার

২০
X