ড. সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

একটি বইয়ের আলেখ্য

মো. সিরাজুল হকের লেখা Principles of Civics and Economics বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি : সংগৃহীত
মো. সিরাজুল হকের লেখা Principles of Civics and Economics বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি : সংগৃহীত

‘ঐ বইটা কি’? একেবারে ওপরের তাকের একটি বিবর্ণ তামাটে রঙের বইয়ের দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল শামীম। বেশ ক'বছর আগে নিউইয়র্কে যখন বেড়াতে এসেছিল ও, তখন বইঘরে ঢুকে বই দেখাচ্ছিলাম ওকে। ঠোঁটের কোনে আমার মৃদু হাসি খেলে গেল, জানা আছে আমার ঐ বইটা কি। পেড়ে আনলাম ওপর থেকে। ফুঁ দিয়ে ধুলো সরালাম, তারপর ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা আমার বাবার লেখা প্রথম পাঠ্যপুস্তকের প্রথম সংস্করণ। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল কোলকাতায়’।

দু’জনে মিলে বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে ওর হাতের বইটার দিকে তাকালাম। ৬৬ বছর আগেকার বই - বাঁধাইয়ের পাশটা একটু খুলে গেছে, মলাটের রংটা একটু জ্বলে গেছে, পৃষ্ঠা গুলো একটু বিবর্ণ। না’হলে আর সবই ঠিক আছে। ‘Principles of Civics and Economics’ বইটির প্রচ্ছদের মাঝখানে সে সময়কার চল অনুযায়ী গ্রন্থকারের নাম - Md. Sirajul Haq M.A, আমার প্রয়াত পিতা।

নিচে প্রকাশকের নাম। বইটি ছাপা হয়েছিল কলকাতায়। বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে বাবার বি.এম. কলেজের সহকর্মী ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু দর্শনের অধ্যাপক প্রয়াত কাজী গোলাম কাদিরের বইয়ের বিজ্ঞাপন। বলে নেই, তিনিই আমাকে আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

মনে পড়ল, অধ্যাপনায় সফলতার সঙ্গে সঙ্গে একজন সফল পাঠ্যপুস্তক প্রনেতাও ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ থেকে প্রায় ৫০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে (জীবনানন্দ দাশের সহকর্মী ছিলেন তিনি) তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার হাজার। তার মধ্যে আমার সতীর্থ বন্ধুরাও আছে। বহুল ব্যবহৃত শিক্ষার্থী নন্দিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কারণে তার পরিচিতিও ছিল ব্যাপ্ত এবং ব্যাপক।

ওপরে উল্লিখিত ইংরেজিতে লেখা বইটির প্রায় ১৫ টি সংস্করণ বেরিয়েছিল ১৯৪৮-৬০ সালের মধ্যে। শুনেছি, বইটিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসনের পক্ষে জোরালো কথা থাকায় সেটি প্রায় নিষিদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিধর আমলা আলতাফ গওহর বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

ষাটের দিকে জোড়া বিষয় ভেঙ্গে গিয়ে পৌরনীতি ও অর্থনীতি যখন আলাদা হয়ে যায়, তখন যৌথ বইয়ের বদলে বেরুল দু’টো বই - ‘Principles of Civics’ এবং ‘Principles of Economics’. সে বই দুটোর প্রায় ২০টি সংস্করণ হয়েছিল ১৯৬০ - ১৯৭০ সময়কালে।

ততদিনে মাধ্যমিকোত্তর পর্যায়ে বাংলায় পড়াশোনা বিস্তার লাভ করেছে। ফলে প্রকাশিত হলো ‘আধুনিক পৌরবিজ্ঞান’ ও ‘আধুনিক ধনবিদ্যা’। আশির দশকের শেষাশেষি সে বইদু’টোরও ৩৫ সংস্করণ বেরিয়েছিল বলে জানি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক হয়ে কি করে অর্থনীতির ওপরে অমন একটি সফল পাঠ্যপুস্তক বাবা রচনা করেছিলেন, অর্থনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে তা এখনও আমার কাছে একটি বড় বিস্ময়।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক, তখন আমার নামটিও যৌথ লেখক হিসেবে যোগ করেছিলেন তার অর্থনীতি গ্রন্থে। কী কারণে এটা করেছিলেন, তা আমার জানা নেই। হয়ত পুত্রের প্রতি অপত্য স্নেহই তাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ে অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক ছিল বাবার। কিন্তু কোনটিই উপর্যুক্ত গ্রন্থগুলোর মতো আদৃত হয় নি। সে ব্যাপারে তার অবস্থান অনেকটা একচ্ছত্র ছিলই বলা যায় বহু বছর ধরে।

এই সব গল্প আমি করছিলাম শামীমকে, যার হাতে আমার প্রয়াত অধ্যাপক পিতার প্রথম গ্রন্হের প্রথম সংস্করণটি। কথা বলতে বলতে ও বইয়ের প্রচ্ছদটি ওল্টালো অনেকটা আনমনাভাবেই। তারপর আমরা যুগপৎভাবেই চমকালাম। বিভিন্ন সময়ে আমি বইটি হাতে নিয়েছি, নেড়ে চেড়ে দেখেছি, কিন্তু ভেতর উল্টিয়ে পড়েছি বলে মনে পড়ে না।

প্রচ্ছদের পরের প্রথম পাতায় খুব গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কিছু কথায় গ্রন্থকার এ গ্রন্থ রচনায় তার স্ত্রীর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন বড় মায়াময় ভাষায়। সাদামাটা কথায়, আমার বাবা আমার মাকে কিছু কথা লিখেছেন। ওটা পড়ে আমার তিনটা কথা মনে হল।

এক, এ লেখাটি ভিন্ন আমার মা-বাবার মধ্যে কোন চিঠি লেখালেখির নজির আমি পাই নি। লিখেছেন নিশ্চয়ই ভালোবাসার চিঠি যৌবনে এবং প্রয়োজনীয় সাংসারিক পত্র পরবর্তী সময়ে। আমরা দেখিনি।

দুই, এই স্বল্প ক’টি কথার মধ্যে একদিকে যেমন আমার মায়ের অবদানের স্বীকৃতি আছে, তেমনি তো আছে একজন কিশোরী স্ত্রীর প্রতি একজন তরুণ স্বামীর অনুরাগের কথা। বিয়ের সময়ে আমার মায়ের বয়স ছিল ১৬ বছর, বাবার ২২ বছর।

তিন, কথাটি বাবার লেখার মধ্যে নেই, তবু বলি। আমার নামের দ্বিতীয় অংশ ‘জাহান’ আমার মায়ের নাম থেকে নেয়া। আমার মায়ের নাম ছিল ‘জাহানারা’। সুতরাং আমার বাবা তার পারিবারিক পদবি ‘হক’ আমার নামের সঙ্গে যুক্ত না করে আমার মায়ের নামেই আমার নামকরণ করেছিলেন। আজ থেকে ৭০ বছরেরও বেশী সময় আগে আমাদের এ সমাজে যে তরুণ স্বামী এবং পিতাটি এ যুগান্তকারী কাজটি করেছিলেন, তিনি যে আমারই জনক, সেটা ভাবতেই অবাক মানি, আপ্লুত হই, নমিত হই।

লেখাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে কখন যে চোখ ভিজে উঠেছে, খেয়ালও করি নি। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন দেখলাম, লেখার অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। টের পেলাম, শামীমের হাতটি আমার পিঠের ওপর আলতো করে রাখা। তারপর আনমনে দু’জনেই অতি ধীরে, প্রায় নি:শব্দে, বড় মমতায় বইটি মুড়ে রাখলাম।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেট্রোরেলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার কিশোর

মানবপাচারের মামলায় গ্রেপ্তার মিল্টন সমাদ্দার 

‘মানুষের হাত-পা কেটে পৈশাচিক আনন্দ পেত মিল্টন’

মিল্টন সমাদ্দারের আরও ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ 

আরও ছড়াল সুন্দরবনের আগুন, নিয়ন্ত্রণে আসেনি ২২ ঘণ্টায়ও

আদালতে মিল্টন সমাদ্দার 

সেনাবাহিনীকে আরও দক্ষ করে তোলা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণা

ওমরাহ পালন করেছেন ফখরুল দম্পতি

এবার রাশিয়ার ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় জেলেনস্কি

১০

বিশ্বকাপ ট্রফি গেল গণভবনে 

১১

কালবৈশাখী ঝড়ে ঘরচাপায় ৫ বছরের ছেলেসহ অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যু

১২

ভালো নেই মুচি সম্প্রদায়ের মানুষজন, ছাড়ছেন পেশা

১৩

সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী

১৪

চালকের আসনে হুমা

১৫

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

১৬

ঢাকার বাতাসের কী খবর?

১৭

শিশুদের হাতে মোবাইল দিলে বিপদ

১৮

বিরাট অর্জনের পথে শাকিব (ভিডিও)

১৯

গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-কাতারের নীলনকশা

২০
*/ ?>
X