সারা দেশে যখন সরকার পতনের আন্দোলনে সরব বিএনপি-জামায়াত, ঠিক তখনই দুজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোভিজ। এই দুজন হলেন ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বর্তমানে তারা দেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।
জানা গেছে, উইলিয়াম বি মাইলাম ১৯৯০ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুরু হয় আরও আগে ১৯৮৫ সাল থেকে। সে সময় তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, যার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন দেশে আমেরিকার দান-অনুদানের জন্য নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট দেখাশোনা করা। আর এই সূত্রে তিনি বাংলাদেশের জন্য গঠিত দাতা সংস্থাগুলোর ক্লাব ‘প্যারিস কনসোর্টিয়ামে’ আমেরিকার প্রতিনিধি হয়ে হাজির থাকতেন।
সে সময়ে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে শুধু বাংলাদেশের জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর একটি সমন্বয় বৈঠক বসত, প্যারিসে। বাংলাদেশে কাজ শেষে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানেও দায়িত্ব পালন করেন। মূলত সে সময় থেকেই মাইলামের মূল পরিবর্তন ঘটে বলে অনেকে বলে থাকেন।
এ ছাড়াও মাইলাম ওয়াশিংটনভিত্তিক রাইট গ্রুপ ‘রাইট টু ফ্রিডম’-এর প্রেসিডেন্ট। তিনি সাউথ এশিয়ান পারস্পেক্টিভ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সেই একই ম্যাগাজিনের দায়িত্ব পালন করেছেন জন ড্যানিলোভিজ। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে ঢাকায় বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড্যানিলোভিজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি পক্ষে লবিস্ট হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে ড্যানিলোভিজের টুইট বার্তা থেকে। সেখানে দেখা গেছে, তিনি সক্রিয়ভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতায় নিয়োজিত আছেন।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের পরিচিতির সুযোগ হয় এই দুই মার্কিনির। চাকরি থেকে অবসর নিলেও পেশা হিসেবে বেছে নেন লবিস্ট হিসেবে কাজ করাকে। প্রতিষ্ঠা করেন লবিস্ট ফার্ম। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তাদের এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিএনপি-জামায়াত ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী মহলেরও অভিযোগ, সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস, রাইট টু ফ্রিডমসহ নানা মাধ্যমে নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দিচ্ছেন ওই দুই কূটনীতিক। উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন তারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেন তারা।
এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি এসব কর্মকাণ্ডে ওই কূটনীতিকদের অর্থ ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, মার্কিনিদের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা চেষ্টা করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেন প্রতিক্রিয়াশীল এবং মৌলবাদী দলগুলো থাকে এবং আস্তে আস্তে সেই দলগুলো শক্তিশালী হয়। তারা মনে করে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যদি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি না থাকে তাহলে সেই দেশগুলো আস্তে আস্তে কমিউনিস্টদের দখলে চলে যাবে। কট্টর সমাজতন্ত্রবিরোধী উইলিয়াম বি মাইলাম জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করেন, তাদের মদদ দেন। আর এ কারণেই বিএনপি তাকে বেছে নিয়েছে।
সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার মাইলাম আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত তৎপরতার মূলে রয়েছেন। প্রবীণ কূটনৈতিক হওয়ার কারণে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অন্দরমহলে তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। এটিকে পুঁজি করে বিএনপি-জামায়াতপন্থি ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তখনো তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছিলেন। মাইলাম বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধিতা করেন। তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিবন্ধ লেখেন।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়া প্রেক্ষিত ম্যাগাজিনে ড্যানিলোভিজের ‘মার্কিন ভিসানীতি : এর পর কি?’ শিরোনামে লেখাটিতেও কৌশলে বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করেছেন। তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় নেমেছেন। তিনি রিটুইট করে বাংলাদেশ অনেকের কড়া জবাব দিয়েছেন যার মাধ্যমে নিজেকে আওয়ামী লীগের বিরোধী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
মন্তব্য করুন