মুফতি ইয়াহইয়া শহিদ
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:২২ এএম
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ইতিহাস, উৎপত্তি ও শরিয়তের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)—মানবতার মুক্তির দূত, আলোর প্রদীপ এবং করুণার প্রতীক। তাঁর আগমন মানব ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবীর অন্ধকারকে ছিন্ন করে তিনি এনেছিলেন ঈমানের দীপশিখা, যা আজও আমাদের হৃদয়ে আলোকস্তম্ভ হিসেবে জ্বলে। তাই নবীর (সা.) প্রতি মুসলিম সমাজের আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকাটাই স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য।

তবে প্রশ্ন জাগে, তাঁর জন্ম দিবসকে যে আজ ঈদে মিলাদুন্নবী নামে চিহ্নিত করেছি, সেটি কবে, কীভাবে এবং কোন উদ্দেশ্যে উদযাপন শুরু হয়েছিল? আর শরিয়তের মানদণ্ডে এ দিবসের বৈধতা কতটুকু?

ঈদে মিলাদুন্নাবীর উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন এবং তাবে-তাবেয়িনের যুগে নবীর (সা.) জন্মদিন উদযাপনের কোনো নজির নেই। তারা নবীজির (সা.) জন্মকে উৎসব বা ইবাদতের আঙ্গিকে পালন করেননি। ইসলামের প্রথম তিন শ্রেষ্ঠ যুগে এ বিষয়ে পূর্ণ নীরবতা বিরাজমান। কোনো স্কলার এ বিষয়ে কোথাও আলোচনা করেননি। মূলত এ প্রতা শুরু হয় ছয় শতাব্দীতে।

ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎপত্তি নিয়ে গবেষকরা ৩টি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, আরবিলের বাদশাহ মুজাফফর উদ্দিন কুকুবুরি (৬০৪ হিজরি) তৎকালীন ইরাকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে নবীর (সা.) জন্মদিন উদযাপন শুরু করেন। ওই সময়টাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে লোকদের আকৃষ্ট করা হতো। এভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে নবীজি (সা.) জন্মদিন উদযাপনের রীতি চালু হয়। (উইকিপিডিয়া)

দ্বিতীয়ত, ফাতেমি সাম্রাজ্যে (মিসর, হিজরি চতুর্থ শতক শেষের দিকে) শিয়া ফাতেমি খলিফারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে ছয়জনের জন্মদিন উদযাপন করতেন—নবী মুহাম্মদ (সা.), আলী (রা.), হাসান (রা.), হুসাইন (রা.), ফাতিমা (রা.) এবং খলিফা। (আল খিতাত লিল মাকরিজি : ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯০-১৯৯)

তৃতীয়ত, সপ্তম শতাব্দীতে ইরাকের দরবারি উদ্ভাবন। তৎকালীন বাদশাহর পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারি আলেম ওমার বিন মুহাম্মদ মুল্লার নেতৃত্বে জাঁকজমকপূর্ণ মিলাদ অনুষ্ঠান প্রবর্তিত হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১৩ নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)

এই ইতিহাস স্পষ্ট করে, সাহাবা, তাবেয়িন ও তাবে-তাবেয়িনের যুগে নবীজির (সা.) জন্ম উদযাপন কখনো ধর্মীয় ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পরে কিছু বাদশাহ আর দরবারি আলেম মিলে এটাকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছেন।

শরিয়তের আলোকে বিশ্লেষণ

ইসলামে ইবাদত কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) দ্বারা নির্ধারিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ ভাষ্যে বলেছেন, ‘যে আমাদের দ্বীনে এমন কিছু সংযোজন করবে যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ (বোখারি : ২৬৯৭, মুসলিম : ১৭১৮)

অতএব, নবীর (সা.) যুগে বিদ্যমান না থাকা কোনো কাজ যদি পরে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে চালু করা হয়, তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, ইসলামিক স্কলারগণ বিদআতের সংজ্ঞা এভাবেই করেছন। ইমাম শাতবি বলেন, বিদআত হলো এমন নতুন কিছুর উদ্ভাব, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর পরে দ্বীনের মধ্যে চালু করা হয়েছে। অথচ এর কোনো ভিত্তি শরিয়তে নাই। (আ.ইতিসাম : খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-৩৭)

ইসলামে ঈদ উল্লিখিত আছে মাত্র ৩টি—ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা এবং সাপ্তাহিক জুমার দিন (বোখারি : ৯৫২, ইবনে মাজাহ : ১০৯৮)। এই তিনটির বাইরে নতুন কোনো ঈদ উদ্ভাবন করা শরিয়তের আলোকে বৈধ নয়। নবীজির (সা.) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন আবিষ্কার করারও প্রয়োজন নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলাদুন্নবীকে ঘিরে অনুষ্ঠান প্রায়শই রঙিন শোভাযাত্রা, গান-বাজনা, আতশবাজি ও ব্যয়বহুল আয়োজনের আকার ধারণ করেছে। এতে ইসলামের মৌলিক চেতনা—সহনশীলতা, নৈতিকতা ও সরল ইবাদতের উদ্দেশ্য বিসর্জিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন : ঘরে মৃত মানুষের ছবি টানানো যাবে কি? যা বলছে হাদিস

আরও পড়ুন : ডাকসু নির্বাচন : যাকে ভোট দিতে বলছেন শায়খ আহমাদুল্লাহ

ইসলামে প্রতিটি ইবাদত নিয়ত ও সুন্নাহের সঙ্গে যুক্ত। নবী (সা.) যা করেননি, তা ইবাদত বানানো মানে শরিয়তের প্রমাণিত সীমা অতিক্রম। মিলাদ উদযাপন তাই মূল ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে মেলেনি এবং বৈধতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং ধর্মীয় উৎসব বা পুণ্যের কাজ মনে করে ১২ রবিউল আউয়ালের সকল আনুষ্ঠানিকতা শরিয়ত পরিপন্থি। শরিয়ত এর বৈধতা দেয় না।

ভালোবাসা প্রকাশের প্রকৃত রূপ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিন বেছে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রকৃত ভালোবাসা হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—তাঁর সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা, কোরআনের শিক্ষা জীবনে অনুসরণ করা, তাঁর চরিত্রকে প্রতিদিনের আচরণে প্রতিফলিত করা এবং সারা বছর দরুদ পাঠ ও দোয়া অব্যাহত রাখা।

যদি কেউ ১২ রবিউল আউয়ালে ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চান, সেক্ষেত্রে সিরাত পাঠ, দরুদ ও দোয়া বা ইসলামের ইলম নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে যদি সেটা করা হয়, তাহলে সেটি সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু এটিকে ঈদ বা নির্ধারিত ধর্মীয় উৎসব হিসেবে গণ্য করা কখনোই শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।

নির্মোহ পর্যালোচনা

ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, আবেগ ও ভালোবাসা কখনোই ধর্মের মূল চেতনা প্রতিস্থাপন করতে পারে না। নবীর (সা.) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রকৃত পথ হলো তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ, কোরআনের শিক্ষা জীবনে প্রতিফলিত করা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে জীবন আলোকিত করা।

মিলাদ উদযাপন যদি রঙিন আয়োজন, গান-বাজনা, আতশবাজি ও ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়—তাহলে এটি ইসলামিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুত। হানাফি ফিকহের আলেমদের মতে, নবীর (সা.) জন্মকে ঘিরে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদত এবং শিক্ষা কার্যক্রম বৈধ, কিন্তু ধর্মীয় উৎসব হিসেবে তা গ্রহণ করা কখনোই অনুমোদিত নয়। সুতরাং নবীর (সা.) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন আবিষ্কার করার প্রয়োজন নেই, বরং সারাজীবন তাঁর আদর্শ অনুসরণ করাই প্রকৃত শ্রদ্ধার পরিচায়ক।

লেখক : ফাজিল, জামিয়া ইকরা, ঢাকা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিটি আইটি মেগা ফেয়ার ২০২৫-এ টেকনো মেগাবুক সিরিজ

বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিশেষ নির্দেশনা

লঞ্চ থেকে জব্দ ২০০ কেজি জাটকা গেল এতিমখানায়

ওষুধ ভেবে ইঁদুর মারার ট্যাবলেট খেয়ে দুই বেয়াইয়ের মৃত্যু

অগ্নিদগ্ধ রোগী দেখতে যাওয়ার পথে হামলা, আহত ৫

২ জেলার দুই নেতাকে সুখবর দিল বিএনপি

জুলাই শহীদ আবুল হাসান স্বজনের কবর জিয়ারত মাসুদুজ্জামানের

যুবদলের ২ নেতাকে বহিষ্কার, একজনকে শোকজ

সাংবাদিক শওকত মাহমুদ কারাগারে, রিমান্ড শুনানি বৃহস্পতিবার

যে কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ হবে

১০

স্বাস্থ্যসেবায় নারী চিকিৎসকদের অগ্রগতির বাধা চিহ্নিত করতে চমেকে সেমিনার

১১

রাতে হঠাৎ আগুন, দশটি বসতঘর পুড়ে ছাই

১২

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত, সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে?

১৩

২৩ বছর ছদ্মবেশে থেকেও রক্ষা পেলেন না হাফিজ

১৪

ঢাকায় নতুন হুন্ডাই ক্রেটা গ্র্যান্ডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন

১৫

পুলিশের ঊর্ধ্বতন ২২ কর্মকর্তাকে বদলি

১৬

ফের রিমান্ডের খবরে নাসার নজরুল বললেন ‘হার্ট অ্যাটাক করব’

১৭

প্রাণিসম্পদ অফিসে দুর্ধর্ষ চুরি

১৮

স্ত্রীর মরদেহ বাথরুমে লুকিয়ে রাখে স্বামী, অতঃপর...

১৯

ঘরে মাকড়সার জাল থাকলে কি অভাব-অনটন দেখা দেয়?

২০
X