ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালনের পর আসে এই খুশির দিন। দিনটি সকল মুসলমানদের জন্য বড় নিয়ামত।
রোজা পালন শেষে দিনটি আনন্দ নিয়ে আসে সকলের ঘরে। এ আনন্দ শুধু একটি শ্রেণির জন্য নয়। ঈদের এই আনন্দ ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার জন্য, যা সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ।
মূলত ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। যেহেতু প্রতিবছরই এটা ফিরে আসে তাই একে ঈদ বলা হয়। বারবার দিনটি ফিরে আসে আনন্দ নিয়ে। যা ছড়িয়ে পড়ে গরিব থেকে ধনী সকলের মধ্যে।
ঈদের সারা দিন আনন্দ উল্লাসে কেটে দেব এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এর মাঝেও বেশকিছু কাজ রয়েছে যা আপনার এই দিনটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে দেবে। শুধু আনন্দ-উৎসবে মেতে না থেকে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার-
ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকে আমরা প্রস্তুতি নেব মাঠের নামাজ আদায়ের জন্য। এ জন্য প্রথমেই আমরা নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করব। হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [সুনানে বায়হাকী: ৫৯২০]
যেহেতু ঈদ খুশির দিন। সেহেতু নতুন পোশাক পরে ঈদ উদযাপন করা উত্তম। সবার উচিত আল্লাহর নিয়ামত আল্লাহর শোকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। রাসুল সা. বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তার বান্দার ওপর তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ [সহিহ আল জামে: ১৮৮৭]
ঈদুল ফিতরের মাঠের নামাজ আদায়ে যাওয়ার আগে মিষ্টি খাবার গ্রহণ করা। রাসুল সা. ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। [তিরমিজি-৫৪৫]
একই সঙ্গে এতিম ও যে অভাবে আছে তাদের খাবার খাওয়ানো, খোঁজখবর নেয়া; এটা ইমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এরপর হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া বা তাকবির পড়তে পড়তে যাওয়া। এটা রাসুল (সা.) এর সুন্নত। হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত’। [বুখারী :৯৮৬]
ঈদগাহে যেয়ে সাধ্যমতো দান করা। অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্যসামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরিয়তের পরিভাষায় তাকেই জাকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিলেন।’ [সহিহ বোখারি: ১৫০৩]
ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ তাকবির পাঠ করা। এটা সুন্নত। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সা. ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে তাকবির পাঠ করতে করতে ঈদগাহে যেতেন।[মুসতাদরাক :১১০৬]
মনোযোগ দিয়ে ঈদের খুতবা শোনা : আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সা. এর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, তখন বললেন, ‘যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে’। [সুনানে আবু দাউদ :১১৫৭]
ঈদের নামাজ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা একজন রোজাদারকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দুই রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি।’ [সহিহ বোখারি: ৯৮৯]
ঈদের দিন আল্লাহতায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দেন যেমনি তাদের মা তাদেরকে নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। রসুল (সা.) বলেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামাতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে’। [লাতাইফুল মায়ারিফ]
ঈদের নামাজের পর রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের সঙ্গে মুসাহাফাহ ও মুআনাকাহ করতেন।
এরপর সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা। আশপাশের সবার খোঁজ নেওয়া। ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়।
ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা। প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নেওয়া ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়।
এ ছাড়া দিনটিতে করতে পারেন আরও অনেক কাজ। বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন, ছোট-বড় সবার সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠা। মিষ্টি বিতরণ করা। সবার সঙ্গে এমন সময় কাটানোর সময় হয়তো আর নাও পেতে পারেন।
এভাবেই ঈদের পুরো দিনটি আপনি আনন্দ-উল্লাস আর সবার সঙ্গে খুশি বিনিময় করে কাটিয়ে দিতে পারেন। তবে এদিনও মনে রাখতে হবে এমন কিছু কাজ রয়েছে যা করা উচিত না।
ঈদের দিন রোজা রাখা : ঈদের দিন রোজা রাখতে বলেনি। ঈদের দিন রোজা রাখলে কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সে জন্য হাদিসে ঈদের দিন রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ [সহিহ মুসলিম: ২৭৩০]
ঈদের আনন্দে এমনভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের নামাজে অমনোযোগী।’ [সূরা মাউন: ৪-৫]
ঈদ উপলক্ষে যে বেশি বেশি বা অযথা ব্যয় করবেন, তা ঠিক না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ -সুরা বনি ইসরাঈল: ২৬-২৭
অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এ জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে।’ -সহিহ মুসলিম: ৪৫৯০
এগুলো শরিয়তবিরোধী কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ [সূরা মায়িদা: ৯০]
ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আটকে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘মুসলিম ওই ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্যরা নিরাপদ।’ [সহিহ বোখারি : ৬৪৮৪]
ঈদে আনন্দ করতে বলা হয়েছে তবে নামাজ আদায়ের বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। অনেকেই ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নামাজ আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের নামাজ আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।
মন্তব্য করুন