পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়। প্রতিটি মানুষ নির্ধারিত সময়ে স্বল্পক্ষণের দুনিয়াকে বিদায় জানায়। কারণ, মানুষের জন্ম হওয়া মানেই মৃত্যু অবধারিত। চিরঞ্জীব ও চিরন্তন কেবল মহান আল্লাহ। অনেকে মনে করে থাকেন যে ঈদের দিন কোন মুসলমান ব্যক্তি মারা গেলে তার কবরের আজাব মাফ হয়ে যায় এবং বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করনে। তবে এ বিষয়ে কুরআন বা হাদিস কী বলে?
ঈদের দিন মারা গেলে কী হয়- সে সম্পর্কে কোনরকম কুরআনের আয়াত বা হাদিস পাওয়া যায় না। ঈদের দিন মারা গেলে জান্নাত পাওয়া যায় এ কথাটিও সঠিক নয় বলে মনে করেন আলেম ওলামাগন।
ঈদের দিন সম্পর্কে এধরণের কোন হাদিস না থাকলেও জুমার দিন অর্থাৎ শুক্রবার সম্পর্কে এধরণের একটি হাদিস রয়েছে যে শুক্রবারের দিন বা রাতে কেউ মারা গেলে তার কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন, ‘যেকোনো মুসলমান ব্যক্তি জুমার দিনে মৃত্যুবরণ করলে নিশ্চয়ই কবরের ফিতনা না থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। (তিরমিজী, হাদিস নং: ১০৯৫, মিশকাত, হাদিস নং:১৩৬৭)।
তবে পরবর্তীতে আবার আজাব ফিরে আসবে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা নেই।
প্রতিটি মুসলমান ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। এখন এই তিনটি প্রশ্ন কি কি তা আমাদের প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত। প্রশ্ন তিনটি হচ্ছে - মান রাব্বুকা? ওয়া মান দিনুকা? ওয়ামান নাবিয়ুকা? অর্থাৎ তোমার রব কে? তোমার দিন কী এবং তোমার নবী কে? এই তিনটি প্রশ্ন করা হবে কবরে।
যারা ইমান আনবে আমল করবে তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। আর যারা ইমান আনেনি আমল করেনি তারা পারবে না। তাই এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে ইমান আনুন এবং আমল করুন। আশা করি কবরের প্রশ্ন কয়টি করবেন তা জানতে পেরেছেন। এবার চলুন কবরের আজাব থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিন।
কবরের আজাব থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে একটাই সেটা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য হওয়া এবং ইবাদত করা। কবরের আজাব থেকে বাচতে চাইলে আপনাকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। রমজান মাসের রোজা পালন করতে হবে, যাকাত দিতে হবে। সামর্থ্য থাকলে হজ আদায় করতে হবে।
অর্থাৎ আপনাকে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে যা নিষেধ তা করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যেগুলো ফরজ করে দিয়েছে সেগুলো মেনে চলতে হবে তাহলেই আপনি কবরের আজাব থেকে মুক্তি পাবেন।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কেয়ামতের দিন তোমাদের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। তারপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান করো, তবুও।’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ৭৮)
নিজের আত্মীয়-স্বজন, আপনজন কিংবা কাছের ও পরিচিত যে কারও মৃত্যু হতে পারে। আর এসব অবস্থায় মানুষের মন ভারাক্রান্ত থাকে। বিচ্ছেদ-কষ্টে ব্যথাতুর হয়। তাদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর কিছু করার প্রবল ইচ্ছা জন্ম নেয় মনে। তাদের জন্য দোয়া ও মাগফিরাত করতে খুব ইচ্ছে হয়।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! যেদিন হিসাব প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সব ঈমানদারকে ক্ষমা করুন।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪১)
অন্য জায়গায় নূহ আলাইহিস সালামের এ দুআ বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার পিতা-মাতাকেও এবং যে ঈমান অবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে আর সমস্ত মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকেও।’ (সুরা নুহ, আয়াত : ২৮)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমলের ফায়দা ভোগ করে—সদকায়ে জারিয়া; এমন জ্ঞান, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং ওই সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৬৩১)
নবী কারিম (সা.) যেভাবে দোয়া করতেন, তার কয়েকটি এখানে দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। (কবরস্থ ব্যক্তির জন্য দোয়া)
اللهُـمِّ اغْفِـرْ لَهُ وَارْحَمْـه، وَعافِهِ وَاعْفُ عَنْـه ، وَأَكْـرِمْ نُزُلَـه ، وَوَسِّـعْ مُدْخَـلَه ، وَاغْسِلْـهُ بِالْمـاءِ وَالثَّـلْجِ وَالْبَـرَدْ ، وَنَقِّـهِ مِنَ الْخطـايا كَما نَـقّيْتَ الـثَّوْبُ الأَبْيَـضُ مِنَ الدَّنَـسْ ، وَأَبْـدِلْهُ داراً خَـيْراً مِنْ دارِه ، وَأَهْلاً خَـيْراً مِنْ أَهْلِـه ، وَزَوْجَـاً خَـيْراً مِنْ زَوْجِه، وَأَدْخِـلْهُ الْجَـنَّة ، وَأَعِـذْهُ مِنْ عَذابِ القَـبْر وَعَذابِ النّـار
উচ্চারণ : আল্লাহহুম্মাগ ফিরলাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আফিহি ওয়া ফু আনহু; ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি মাদখালাহু; ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়ানাক্কিহি মিনাল খাতা-ইয়া কামা ইউননাককাস সাওবুল আব ইয়াযু মিনাদদানাসি; ওয়াবদিলহু দা-রান খায়রান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি; ওয়া যাওজান খাইরান মিন যাওজিহি। ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা, ওয়া আইজহু মিন আযাবিল কাবরি ওয়ামিন আযাবিন নার।
অর্থ : হে আল্লাহ্, তাকে ক্ষমা করুন এবং তাকে দয়া করুন। শান্তিতে রাখুন এবং তার থাকার স্থানটিকে মর্যাদাশীল করুন। তার কবর প্রশস্থ করে দিন। বরফ ও তুষারের শুভ্রতা দিয়ে, তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করে দিন— যেমন ময়লা থেকে সাদা কাপড় পরিষ্কার হয়। তাকে দুনিয়ার বাসস্থানের চেয়ে উত্তম বাসস্থান, পরিবার ও সঙ্গী দান করুন, হে মাবুদ, তাকে জান্নাতে দাখিল করুন, তাকে কবর আর দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুণ। (মুসলিম, হাদিস : ২/৬৩৪)
আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর সাহাবি আওফ বিন ইবন মালিক (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে মৃত ব্যক্তির জন্য এমন দোয়া করতে দেখে— আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম যে, যদি সেই মৃত ব্যক্তিটি আমি হতাম।’
রাসুল (সা.) কবর জিয়ারত করে এভাবে দোয়া করতেন বলে হাদিসে এসেছে—
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ
উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম; আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আসারি।
অর্থ : হে কবরস্থানের বাসিন্দাগণ, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। আমরাও আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব/আপনাদের সঙ্গে মিলিত হব।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯৭৪; মুসলিম, মিশকাত হাদিস : ১৭৬৭)।
মন্তব্য করুন