ঢাকার সেটেলমেন্ট কোর্টের বিচারক জেলা জজ জুয়েল রানার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ পুনঃতদন্ত চেয়ে করা আবেদন হাইকোর্টও খারিজ করে দিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য এবং ভুক্তভোগী তরুণীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শেখ আতিয়ার রহমান।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য কালবেলাকে বলেন, ধর্ষণের অভিযোগের পুনঃতদন্ত চেয়ে একটি আপিল ছিল। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালে হাইকোর্ট আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে। চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার আপিলটি খারিজ করেন।
ভুক্তভোগী ওই তরুণী জানিয়েছেন, হাইকোর্টেও তিনি ন্যায় বিচার পাননি। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করবেন। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ভুক্তভোগী ওই তরুণী ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়, নারায়ণগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তখনকার বিচারক (জেলা জজ) জুয়েল রানাকে। ওই বছরের ২৪ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ তরুণীর অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে (সিএমএম) তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
তরুণী তার মামলার অভিযোগে বলেন, বিচারক জুয়েল রানা ঢাকার আদালতে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি পারিবারিক রিভিশন মামলা তার (বিচারক জুয়েল রানা) আদালতে বিচারাধীন ছিল। পরে বিচারক নিজে ফোন করে তাকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেন। বিচারক তার আদালতে অস্থায়ী স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকরি নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তরুণীকে সাঁটলিপি শেখার জন্য ভর্তি হতে বলেন। এমন আচরণের মাধ্যমে তরুণীর বিশ্বাস অর্জন করেন বিচারক।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বিচারক জুয়েল রানার অধীনে নিয়োগ পরীক্ষা হলেও তরুণীকে সরকারি চাকরি না দেওয়ায় তিনি অন্য কোম্পানিতে চাকরি নেন। তখন বিচারক জুয়েল রানা আবার তরুণীকে ফোন দিয়ে তার আদালতে আসতে বলেন। কিন্তু তরুণী না আসতে চাইলে তার পারিবারিক মামলার আপিলে ক্ষতি করে দেবেন বলে হুমকি দেন। তখন তরুণী বাধ্য হয়ে আবার বিচারক জুয়েল রানার আদালতে আসেন এবং অস্থায়ীভাবে তার আদালতে কাজ করতে থাকেন। তরুণী মামলায় আরও বলেন, ২০১৫ সালের ৮ জুন বিচারক তরুণীকে তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তার বাসায় নিয়ে যান। তবে সেদিন বিচারকের বাসায় তার স্ত্রী-সন্তান ছিলেন না। একপর্যায়ে হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের কথা কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেন বিচারক। এজাহারে বলা হয়, ওই তরুণী সেদিন বিচারকের বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে যান। পর দিন রমনা থানায় বিচারকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে যান তরুণী। তবে অতিরিক্ত জেলা জজ শুনে মামলা না নিয়ে পুলিশ তরুণীকে আদালতে মামলা করতে বলেন। তরুণী সেদিন আদালতে তার ল্যাপটপ আনতে যান। তখন বিচারক তাকে অফিসে কাজ করতে বলেন। মুখ খুললে মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দেন বিচারক। পরে তরুণী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিচারক তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তরুণীর সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন বলে বিচারক তাকে আশ্বস্ত করেন। সুস্থ হলে তরুণীর সঙ্গে মীমাংসার প্রতিশ্রুতি দেন।
তরুণী তার মামলায় বলেন, ছয় মাস অসুস্থ থাকার পরও সুস্থ না হলে বিচারকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর তার খাসকামরায় দেখা করেন তিনি। সেদিন বিচারককে বিয়ে করে চিকিৎসক দেখিয়ে সুস্থ করে তুলতে বলেন তরুণী। তা না হলে আইনের আশ্রয় নেবেন বলে বিচারককে জানান। বিষয়টি নিয়ে খাসকামরায় দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। এরপর ৮ নভেম্বর রাতে র্যাব তরুণীকে আটক করে নিয়ে যায়। সেদিন র্যাব সদস্যরা ধর্ষণসংক্রান্ত চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে যায়। তরুণীর বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় ২০টি ইয়াবা বড়ি রাখার অভিযোগে মামলা দেয় র্যাব। ২২ দিন জেল খাটার পর জামিন পান তিনি। এজাহারে বলা হয়, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর র্যাবের নিয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের সনদের কপি তোলার সব চেষ্টাই করেন তরুণী, কিন্তু ব্যর্থ হন। এর মধ্যে বিচারক তার বন্ধু সেলিম পাশাকে দিয়ে তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করান আপসের জন্য। পরে তরুণী ধর্ষণ ও ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদের কাছে যান। বিচারক এ খবর জানতে পেরে চিকিৎসক সোহেল মাহমুদকে ফোন দেন, সনদ না দেওয়ার জন্য বলেন।
তরুণী মামলায় বলেন, বিচারক সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় ইয়াবা মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তরুণীকে তুলে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিচারকের করা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। পরের বছর ২২ ফেব্রুয়ারি তরুণী সেই মামলায় জামিন পান। ধর্ষণের কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও দুটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে তরুণী আদালতকে জানান। এ মামলার পর জেলা জজ জুয়েল রানাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
এ অভিযোগের তদন্ত করে কোনো সত্যতা নেই মর্মে ঢাকার সিএমএম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর প্রতিবেদনটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর একই বছরের ২২ নভেম্বর তরুণীর অভিযোগ খারিজ করে দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাস পাওয়ার পর অভিযুক্ত বিচারক ফের কর্মে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি সেটেলমেন্ট আদালতে কর্মরত রয়েছেন। এদিকে নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ২০১৯ সালে ওই তরুণী হাইকোর্টে একটি ফৌজদারি আপিল মামলা করেন। মামলায় অভিযোগের পুনঃতদন্ত অথবা অভিযোগ আমলে নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। বৃহস্পিতিবার চূড়ান্ত শুনানি করে তা খারিজ করে দেন।
মন্তব্য করুন