ধর্মীয় বিভাজনের সময়ে ভারতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার ছবি ও ভিডিও। এতে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন বহু মানুষ।
মহারাষ্ট্রের পুণেতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এ ঘটনা নেটিজেনদের অনেককেই আশার আলো দেখিয়েছে। অনেকে বলছেন, ‘এটাই নতুন ভারতের মুখ’- যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও মানবিকতার জয়গান হয়।
ঘটনাটি ঘটে পুণে শহরের ওয়ানাওয়াড়ি এলাকায়, স্টেট রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (এসআরপিএফ) মাঠসংলগ্ন অলংকরণ লনে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে সংস্ক্রুতি কাওয়াড়ে ও নরেন্দ্র গালান্ডে নামে এক হিন্দু যুগলের বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
মঞ্চ তৈরি, পুরোহিত উপস্থিত, অতিথিরা ভিড় জমাচ্ছেন- সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কিন্তু হঠাৎ শুরু হয় অঝোর ধারায় বৃষ্টি। খোলা লনের মাটি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। অতিথিরা ছুটোছুটি শুরু করেন আশ্রয়ের জন্য। বৃষ্টিতে ভেসে যেতে বসে দুই মাসের পরিকল্পনার বহু প্রতীক্ষিত সেই বিয়ে।
ঘটনাটি যখন একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন সংস্ক্রুতি কাওয়াড়ের পরিবারের চোখ পড়ে পাশের একটি ব্যাংকোয়েট হলের দিকে। সেখানে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক কাজীর ছেলে মহসিন ও পাত্রী মাহিনের ওয়ালিমা (মুসলিম বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান) চলছিল।
হিন্দু পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা ফারুক কাজীর কাছে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। অবাক করে দিয়ে এক মুহূর্তও দেরি করেননি কাজী সাহেব। নিজের অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার মাঝেই ব্যাংকোয়েট হলের একটি অংশ হিন্দু পরিবারের জন্য ছেড়ে দেন। শুধু তাই নয়, তার পরিবার ও অতিথিরাও হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেন।
এরপর ঘটে এক অনন্য ঘটনা- একই মঞ্চে প্রথম হিন্দু বিবাহ, এরপর মুসলিম ওয়ালিমা সম্পন্ন হয়। অতিথিরা উভয় পক্ষের অনুষ্ঠানে অংশ নেন, একসঙ্গে নৈশভোজ করেন। দুই সংস্কৃতির মানুষদের এই মিলনমেলায় যেন নতুন এক ভারতকে খুঁজে পান অনেকে।
পেশায় আইনজীবী, কাওয়াড়ে পরিবারের বন্ধু অ্যাডভোকেট নীলেশ শিন্ডে বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম বৃষ্টি হয়তো ১৫ মিনিটের মধ্যে থেমে যাবে, কিন্তু তা না হয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তখন পাশের হলের মুসলিম পরিবারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাই। তারা নিজের পরিবারের বিয়ের আয়োজন ভুলে গিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ান।
সংস্ক্রুতির ঠাকুরদাদা সান্তারাম কাওয়াড়ে বলেন, আমরা দুই মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যখন মনে হলো অনুষ্ঠানটি আর হবে না, তখন মনটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু কাজী পরিবার আমাদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছে, তা চিরকাল মনে রাখব।
সংস্ক্রুতির বাবা চেতন কাওয়াড়ে বলেন, আমাদের মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে এক মুসলিম পরিবার যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তা শুধু উদারতা নয়, এটা মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
অন্যদিকে, ফারুক কাজী বলেন, আমি যখন দেখলাম তাদের অনুষ্ঠান ভেস্তে যাচ্ছে, তখন মনে হলো ওরাও তো আমার মেয়ের মতোই। এক বাবার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সাহায্য করেছি। ভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে, এমন একটি মুহূর্তে পাশে থাকতে পেরে।
শেষ পর্যন্ত দুই নবদম্পতি এবং দুই পরিবার রাতভর আনন্দে মেতে ওঠেন। একসঙ্গে তোলা গ্রুপ ছবি, হাসিমুখে খাবার খাওয়ার দৃশ্য- সবই এখন ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পুণের এই একটি রাতের ঘটনা হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক স্থায়ী প্রতীক।
সূত্র : ফ্রি প্রেস জার্নাল
মন্তব্য করুন