নব্বইয়ের দশকে দেশে বোতলজাত পানি ব্যবহারকারীকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ভাবা হতো। এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। বোতলজাত পানির ব্যবহার কিংবা কিনে খাওয়ার প্রবণতা শুধু অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা মধ্যবিত্তের সিঁড়ি বেয়ে নিম্নবিত্তের গণ্ডিতেও জায়গা করে নিয়েছে। এভাবে বোতলজাত পানি এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নগর জীবনে এর ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে বেড়েছে।
প্রতিদিন হোটেল-রেস্তোরাঁ, সরকারি-বেসরকারি অফিস, বিভিন্ন জাতীয় ও সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, ভ্রমণপথে বোতলজাত পানি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এমনকি অনেক বাসাবাড়িতেও এখন বোতলজাত পানি ব্যবহৃত হচ্ছে।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ব্যবহারহারী ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দশকের ব্যবধানে সারা দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় পানির বেশ অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর বিপরীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সরকারের ব্যর্থতা গত এক দশক ধরে বোতলজাত পানির অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য রীতিমতো বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত হয়েছে। দেশজুড়ে ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও এ খাতে বিনিয়োগ এনেছে। এতে আরও বড় হচ্ছে পানির বাজার।
উৎপাদকদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির বাজার এখন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রতিবছর ৪০ থেকে ৪৫ কোটি লিটার বোতলজাত পানির চাহিদা রয়েছে। এর বাইরে জারের পানির বাজারও বড় হচ্ছে। প্রতিবছরই বোতলের পানির বাজারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে। এখন পর্যন্ত ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানকে পানি বিক্রির অনুমতি দিয়েছে সরকারের মাননিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই। এর মধ্যে ৪৭টি কোম্পানিকে বোতলজাত ও ১৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে জারের পানি বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল হক কালবেলাকে বলেন, বোতলজাত পানির চাহিদা বাড়ার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। প্রতিনিয়ত পানি বিক্রি অনুমতি পাওয়ার আবেদন করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজারটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে, বিশেষ করে পর্যটন স্পট, লবণাক্ততাপ্রবণ অঞ্চল এবং ঘনদূষিত এলাকায় চাহিদা বেশি। এ ছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে বোতলজাত পানির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রথম বোতলজাত পানির ব্যবসা শুরু করে পারটেক্স গ্রুপ। বর্তমানে বাজারের ৪০ শতাংশই পারটেক্সের ব্র্যান্ড মাম পানির দখলে। প্রতিষ্ঠানটির এজিএম (ব্র্যান্ড) নাহিদ ইউসুফ কালবেলাকে বলেন, পানি ব্যাপারটা খুবই সেনসেটিভ। সবাই স্বাস্থ্যসচেতন এবং পানির বিষয়ে সতর্ক থাকতে চায়। এ কারণে মানুষ এখন পানি কিনে খাচ্ছে। এসব কারণে বোতলজাত পানির বাজার ধারাবাহিকভাবে বড় হচ্ছে। এটা বাড়তেই থাকবে। সেইসঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। এতে পণ্যের মানও ভালো হচ্ছে।
১৯৯৮ সালে দেশে ফ্রেশ নামে পানি বিক্রি শুরু করে মেঘনা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ওই সময়ে কেনা পানির প্রতি মানুষের এত আগ্রহ ছিল না; কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন বোতলজাত পানি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, মাম ও ফ্রেশের পাশাপাশি প্রাণ-আরএফএলের প্রাণ, সিটি গ্রুপের জীবন, আকিজ গ্রুপের স্পা, একমি গ্রুপের একমি ড্রিংকিং ওয়াটারসহ দেশে ৩০টিরও বেশি পানির ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ৪৭টি কোম্পানি বোতলজাত পানির ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে আছে ঢাকা ওয়াসার শান্তি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মুক্তা। বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানও বোতলজাত পানি বিক্রি করছে। ২০১৪ সালে পেপসিকো (অ্যাকুয়াফিনা) ও ২০১৬ সালে কোকা-কোলার (কিন্লে) মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাংলাদেশে পানি বিক্রি শুরু করেছে।
খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে আধা লিটারের পানির বোতলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এক বা দুই লিটার পানিরও চাহিদা রয়েছে বেশ। এদিকে বোতলজাত পানির বাইরে আছে জারভর্তি পানির ব্যবসা। সারা দেশে প্রায় প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি অফিস এমনকি শহর এলাকার অনেক বাসায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে জারের পানি। কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা না থাকায় এ খাতে কেমন বাজার তৈরি হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এখানেও বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে বলেও ধারণা করা হয়।
মন্তব্য করুন