

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবু জাফরের সঙ্গে এক চিকিৎসকের তর্কাতর্কির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওই চিকিৎসক ধনদেব বর্মণকে ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়।
ধনদেব বর্মণের অভিযোগ, ডিজি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেই টেবিল দেখে প্রশ্ন করেন এবং তার নাম জানতে চাওয়ার সময় ‘তাচ্ছিল্যপূর্ণ’ দৃষ্টি প্রদর্শন করেন। পরপর তিনবার একইভাবে নাম জিজ্ঞেস করায় তিনি অসম্মানিতবোধ করেন।
একই সঙ্গে তিনি স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, নিজেদের বঞ্চিত হওয়া ও চিকিৎসকদের হয়রানির নানা অভিযোগ তুলেছেন।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য মহাপরিচালকের সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। ডিজির নম্বরে ফোন সেটি তার ব্যক্তিগত সহকারী রিসিভ করলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ওদিকে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই চিকিৎসকের দৃঢ়তার প্রশংসা করছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার কথা বলার ধরন শোভনীয় ছিল না।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগেরই সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ বলছেন, ‘চিকিৎসক ও ডিজির বাহাসের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থাপনা সংকটের করুণ অবস্থার প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে সরকারি খাতের চিকিৎসকদের মধ্যে যে বঞ্চনা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ আছে এটি তারই বহিঃপ্রকাশ।’
সন্ধ্যার পরে অব্যাহতি পাওয়া ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি ওই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা সরকারি চাকরি বিধিমালার পরিপন্থি উল্লেখ করে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ধনদেব বর্মণকে জরুরি বিভাগের ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় শনিবার। ওই দিনই বিকেলে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
তার কয়েক ঘণ্টা আগে ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু জাফরের সঙ্গে তার বাহাসের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
ধনদেব বর্মণ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের ইনচার্জ হিসেবে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি চলতি বছরের জুলাই মাসে আবাসিক সার্জন থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। আর এক বছর পরেই তার অবসরে প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় ডিজি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যান। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবহৃত টেবিল দেখে তিনি জানতে চান যে ওটিতে টেবিল কেন।
ক্যাজুয়ালটির ইনচার্জ ধনদেব বর্মণ তাকে জানান যে টেবিল ডাক্তারদের লেখার জন্য। এ নিয়ে বাহাসের সময় ডিজি নিজেই তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে উদ্দেশ করে বলেন ‘অ্যাই ভিডিও করো’।
একপর্যায়ে ডিজি ধনদেব বর্মণকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘হু আর ইউ’। এ সময় ধনদেব বর্মণ এর প্রতিবাদ করেন।
ডিজি তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, কথাবার্তা হুঁশ করে বলবেন। যারা ডিজির সঙ্গে এমন ব্যবহার করে তারা রোগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে।’
ধনদেব বর্মণ বলেন, ‘আমি রোগীর সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু যারা দায়িত্বে আছে তাদের সঙ্গে আমার ব্যবহার ভালো না।’
আরও কথার একপর্যায়ে ডিজি ধনদেব বর্মণকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘....কিন্তু আপনি তো ব্যবহার শিখেন নাই’। ধনদেব বর্মণ পাল্টা বলেন, ‘ঢাকায় তিন দিনের প্রশিক্ষণ করলাম; আপনার দুদিন আসার কথা ছিল, একদিনও আসেননি।’
এমন তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে ধনদেব বর্মণ বলেন, ‘আমাকে সাসপেন্ড করেন, নো প্রবলেম।’
পরে তাকে ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে শনিবার বিকেলেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
ধনদেব বর্মণ পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘চাকরির শেষ বয়সে এসে গেছি। আমার বন্ধুরা অধ্যাপক হয়ে গেছে, আর আমাকে লেকচারারই থাকতে হয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ধনদেব বর্মণ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকদের জন্য টেবিল চাকরি জীবনের শুরু থেকে দেখে এসেছি। তারপরেও স্বাস্থ্য বিভাগের অভিভাবক হিসেবে ডিজি পরামর্শ দিলে বা সমালোচনা করলে মেনে নিতাম। কিন্তু তিনি আমার নাম শুনেই তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তিনবার নাম জানতে চেয়েছেন। চাকরির শেষপর্যায়ে এসে যদি সম্মান না পাই তাহলে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সংকট সামাল দিয়েছি সহকর্মীদের নিয়ে। অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামলেছি। কখনো কাজে ফাঁকি দেইনি। সে জন্যই আমার রিয়েকশনটা বেশি ছিল। ওনি সুন্দরভাবে বললে হয়তো ফলো করতাম।’
ধনদেব বর্মণের অভিযোগ, ‘সরকারি চিকিৎসকরা কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে কাজ করেন, সেটি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেয় না। এখানে সব জায়গায় দুর্নীতি। প্রমোশন প্রশিক্ষণ সবকিছুর জন্য নেতাদের ধরতে হয়। অনেক চিকিৎসক এসব কারণে চাকরি ছেড়েছেন। ২০১৩ সালে এমএস শেষ করে কিছুদিন আগে সহকারী অধ্যাপক হয়েছি। এখন অবসরের কাছে।’
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য কয়েক দফা যোগাযোগ করেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কিংবা তার বা তার কার্যালয় থেকে শনিবারের ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো বিবৃতিও আসেনি।
শনিবারই ওই ঘটনার শেষ পর্যায়ে ডিজিকে অন্যদের বলতে দেখা যায় যে ‘আমি তাকে খারাপ কিছু বলিনি।’ তখন ধনদেব বর্মণও ‘সরি স্যার’ বললে ডিজি বলেন ‘সরি বলতে হবে না।’ এ সময় ডিজির মন্তব্য ছিল ‘হি ইজ টোটালি আনফিট ফর দিস হসপিটাল।’
চিকিৎসক ধনদেব বর্মণ ছাড়াও ওই হাসপাতালের আরও একজন চিকিৎসকসহ সরকারি চাকরিরত কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো- প্রমোশন ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা খুবই ক্ষুব্ধ।
তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতেও চিকিৎসকদেরই কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের কাছে ধরনা দিতে হয়। অনেক সময় এসব সুযোগের বিনিময়ে অর্থও দিতে হয়। এ ছাড়া অনেক চিকিৎসক এক যুগেও একটি প্রমোশন পাননি এমন ঘটনাও অনেক।
যদিও এসব অভিযোগের সত্যতা রয়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ।
তিনি বলেন, ধরাধরি করে টাকা পয়সা দিয়ে প্রমোশন নেওয়ার অভিযোগ এখানে অনেক পুরোনো। প্রভাবশালীদের টাকাপয়সা দিয়ে ট্রেনিং করতে যেতে হয়। লোক ধরতে হয় পরীক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য। অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হয় কিন্তু সেগুলো ফেলে রাখা হয়।
তার অভিযোগ, স্বাস্থ্য বিভাগ নিজেই সরকারি চিকিৎসকদের ওউন করে না বলে সবকিছু তাদের নিজেকেই করতে হয়। ফলে চিকিৎসকদের মধ্যে বঞ্চনা আছে, যা ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে।
তার মতে, ডিজির সঙ্গে চিকিৎসকের বাহাসের ঘটনাটি আকস্মিক ঘটনা হলেও এটিই আসলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের মূল চিত্র।
বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ওনি একজন সিনিয়র চিকিৎসক। তাই হয়তো প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু এই খাতে অব্যবস্থাপনার সংকট ভয়াবহ। স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের তো কোনো প্রমোশনই হয় না।’
অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালকের মতে, মানবসম্পদ, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যবস্থাপনার সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন