চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর একটি মেয়াদি আমানতের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু ২০ দিন পার হলেও গ্রাহকের সেই টাকা ফেরত দেয়নি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এ ঘটনা শুধু গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকেই নয়, একই অবস্থায় পড়েছে এতদিন ধরে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব ব্যাংকই। এতদিন এসব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক বেআইনিভাবে যে তারল্য সহায়তা দিয়ে আসছিল, এস আলমমুক্ত হওয়ার পর এসব ব্যাংককে সেই সহায়তা দেওয়া বন্ধ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ফলে তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে এই ব্যাংকগুলোতে যেসব গ্রাহক আমানত রেখেছিলেন, তারা বিপাকে পড়েছেন। এমনকি গ্রাহকের ২০ হাজার টাকার চেকও তারা ক্লিয়ার করতে পারছে না।
সরেজমিন ব্যাংকগুলোতে দেখা গেছে, এই ব্যাংকগুলোতে টাকা তুলতে এসে প্রতিদিনই নিরাশ হয়ে ফেরত যাচ্ছেন আমানতকারীরা। টাকা ফেরত দিতে না পারায় কোনো কোনো ব্যাংকের শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পল্টন শাখায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়াদি আমানতের মেয়াদ শেষ হলেও টাকা তুলতে পারছেন না বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ। কালবেলাকে তিনি বলেন, দুই বছর আগে সাড়ে ৮ শতাংশ মুনাফায় ৩ লাখ টাকা রেখেছিলাম, যা গত ১ সেপ্টেম্বর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাঁচ দিন ব্যাংকে এসেছি, আমার টাকাটা তুলতে; কিন্তু ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। ব্যাংক থেকে তাকে বলা হয়েছে, এখন টাকা নেই। বড় অঙ্কের টাকা জমা হলেই সেটা দেওয়া সম্ভব হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার টাকা দিয়ে এতদিন ব্যাংক ব্যবসা করেছে, যার একটা অংশ আমাকে মুনাফা দেবে। ফলে এখন আমার প্রয়োজনে কেন সেই টাকা ফেরত পাব না? এত খারাপ অবস্থা জানলে এই ব্যাংকে টাকা রাখতাম না—বলেও আক্ষেপ করেন তিনি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এক শাখায় টাকা তুলতে গেলে গ্রাহকের টাকা তো ফেরত দিতে পারেইনি, বরং উল্টো তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে ব্যাংক টাকা রাখার প্রতি মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম ব্যাংক খাত থেকে নামে-বেনামে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। যার অধিকাংশই পাচার হয়ে গেছে। এখন এস আলমের সেই দায় নিতে হচ্ছে সাধারণ আমানতকারীদের।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকারের সহযোগিতায় অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। যার অধিকাংশই পাচার করেছে। এর ফলে এস আলমের লুটপাটের দায় এখন আমানতকারীদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। তিনি বলেন, যেটা পাচার হয়ে গেছে, সেটা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। তবে এখন দেশে তার যে সম্পদ আছে, সেটা বাজেয়াপ্ত করে যতটুকু সম্ভব, আদায় করতে হবে। তা দিয়েই আমানতকারীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা ফেরত দিতে পারবে।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বলেছেন, এস আলম বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যে, পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এভাবে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছেন কি না, জানা নেই। এখন তার নামে-বেনামে থাকা সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। ফলে এ মুহূর্তে এস আলমের সম্পদ না কেনার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে গ্রাহকদেরও ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, একবারে সবাই টাকা তুলতে যাবেন না। তাহলে ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না। অনেকে অতিরিক্ত সুদের লোভে এসব ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। ফলে এখন একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা আমানতকারীদের টাকা যেন ফিরত দিতে পারি, সে ব্যবস্থা করছি। কেননা এটাই বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। তবে আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে আর তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। এতে মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ৯টির মধ্যে আটটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের আমানতকারীরা টাকা তোলার জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন। কিন্তু সংকটের কারণে এসব ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না। এ ছাড়া চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা এটিএম বুথ থেকেও টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। এর বাইরে এক্সিম ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকেও নগদ টাকার সংকট চলছে। নগদ টাকা সংকট শুরু হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেও। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিকল্প উপায়ে এসব ব্যাংকের তারল্য সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির ভিত্তিতে অতিরিক্ত তারল্য আছে এমন ভালো ব্যাংকগুলো সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে পাঁচ ব্যাংক তারল্য সহায়তা পাবে। যেসব ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা চাওয়া হয়েছে সেগুলো সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে অর্থ দেবে।
এ বিষয়ে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এরই ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে চুক্তি সইয়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি জানিয়ে পাঁচ ব্যাংককে গত বৃহস্পতিবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলো হলো বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের বাইরে ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এ পর্যন্ত বিশেষ ধার চেয়ে আট ব্যাংক চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে। পর্যায়ক্রমে সেই ব্যাংকগুলোকেও তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।