জামদানি শাড়ি বুনন শেখার পর গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এক দশক আগে ব্যবসা শুরু করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের ইয়াদ আলী। প্রথমে একটি দিয়ে শুরু হলেও পরে মা এবং স্ত্রী মাহমুদার আর্থিক সহায়তা নিয়ে গড়ে তুলেছেন জামদানি শাড়ি তৈরির কারখানা। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কারণে কারখানা সম্প্রসারণে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সহায়তা নেন। এখন তিনি ২০টি তাঁতযন্ত্রের মালিক। বর্তমানে তার এ কারখানায় ৪০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার গঙ্গানগর গ্রামে ইয়াদ আলী ও মাহমুদা দম্পতির মতো আরও কয়েকটি পরিবারও জামদানি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম আরিফা ও সামাদ দম্পতি। তারাও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি তাঁতযন্ত্র দিয়ে জামদানি তৈরি শুরু করেন। পরে ব্যবসা বড় হওয়ায় এখন আড়াই লাখ টাকা ঋণ চালাচ্ছেন। ব্যবসার লাভের টাকায় ঋণ শোধ করার পাশাপাশি তারা একই ব্যাংকে সঞ্চয়ও করছেন।
এমন অসংখ্য উদ্যোক্তার সাবলম্বী হওয়ার গল্পে জড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের গ্রামীণ ব্যাংক, যা জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে অনেকে তাঁত, টেক্সটাইল উৎপাদন, পশুপালন, মিষ্টি তৈরি, বিউটি পার্লার, জুয়েলারিসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন। এসব ব্যবসার মাধ্যমে তারা অন্যদের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছেন। এভাবে এ জেলার লক্ষাধিক দরিদ্র মানুষ ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আর দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন ঋণগ্রহণকারী ৬৫ শতাংশ মানুষ। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সরেজমিন সফল উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রান্তিক এসব উদ্যোক্তা দাবি করেন, দক্ষতা এবং জামানতবিহীন সহজ ঋণের মাধ্যমে তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার কঠিন পথ সহজ করেছে দেশের চার দশকের পুরোনো ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক।
সোনারগাঁ উপজেলার নয়াপুর বাজারে মিষ্টি তৈরি করেন কৃত্তিবাস ভৌমিক। নিজের কারখানায় তৈরি করে আশপাশের এলাকায় মিষ্টি সরবরাহ করেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য কিছু অর্থের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তারপর পাশে দাঁড়ায় গ্রামীণ ব্যাংক।
গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার মেহেরুন্নেসা বলেন, স্বামীর সঙ্গে প্রায় ৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন আব্দুল্লাহ টেক্সটাইল।
সোনারগাঁয়ের নয়াপুর বাজারে স্বর্ণ, রুপা এবং বিউটি পার্লারের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সুমিধর ও তার স্বামী তপন ধর। সুমিধর জানান, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রথমে স্বর্ণের ব্যবসা শুরু করেন তারা। এরপর ব্যবসা ভালো হওয়ায় রুপার ব্যবসাও শুরু করেন। একই সঙ্গে বিউটি পার্লারের ব্যবসা শুরু করেছেন। এখন তারা পাঁচটি দোকানের মালিক।
গ্রামীণ ব্যাংক শুরু থেকেই ঋণগ্রহীতার সন্তানদের উচ্চশিক্ষার্থে বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করে। নারায়ণগঞ্জে ৬৯৪ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়, যা শিক্ষার্থীরা চাকরি জীবনে প্রবেশের পর পরিশোধ করতে পারবে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক বিনা সুদে ভিক্ষুকদেরও ঋণ দেয়।
সার্বিক বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক এবং নারায়ণগঞ্জ জোনের ম্যানেজার আবুল কালাম বলেন, যোগ্য সদস্যরা কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের বেশিরভাগ সুবিধাভোগীকে সাধারণত সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক এখন কেমন চলছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক আরও শক্তিশালী হয়েছে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বিশেষ করে অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল মাজিদ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন স্বচ্ছতা আসছে। সদস্যরাও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। এসব কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। সরকার এবং ঋণগ্রহীতা সদস্যদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটিতে প্রথম থেকেই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০১১ সালে মুহাম্মদ ইউনূস চলে যাওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক মুখ থুবড়ে পড়বে। সেই ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করে, সরকারি সহযোগিতায় ব্যাংকটি বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে সব সূচকে অগ্রগতির শীর্ষে অবস্থান করছে। বর্তমানে ভালোই চলছে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম। বেড়েছে ব্যাংকটির মুনাফা, ঋণ বিতরণ এবং সদস্য সংখ্যা।
গ্রামীণ ব্যাংকের শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো করছে নারায়ণগঞ্জ জেলা। এ জেলায় সদস্য রয়েছেন মোট ২ লাখ ৮২ হাজার। ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলায় গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩৭২ কোটি টাকা। আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ৭০৪ কোটি টাকা। এ সময়ে আমানত হিসাবে জমা হয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। মে মাস পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জোনে লাভ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। বছর শেষে জোনটির লাভের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৬০ কোটি টাকা। মুনাফা অর্জনে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখাগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ শাখা।
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। শুধু এপ্রিলে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন