কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মূলধন ঘাটতিতে ২৩ ব্যাংক

অর্থনীতি
বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহিত

দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সরকার পতনের পর ব্যাংক খাতের ভেতরের ক্ষতগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে দেশের ২৩টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ১৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। মূলত গত ডিসেম্বরভিত্তিক ২৮টি ব্যাংকে ডেফারেল সুবিধা দিয়েছে, যার ফলে ঘাটতির পরিমাণ কমেছে। তবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মূলধন ঘাটতির পরিমাণ কমলেও ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ে। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে।

জনতা ব্যাংকের ঘাটতি মার্চ শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকায়, যেখানে ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে বলে এই বিশাল ঘাটতি কমে এসেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ দিকে অগ্রণী ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পেয়েও ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। মার্চ শেষে অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে ডেফারেল সুবিধা পেয়ে ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭০ কোটি টাকায়।

অন্যদিকে, বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ডেফারেল সুবিধা পেয়েও বেড়ে ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।

ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে পড়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ১৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সাত হাজার ৭৯০ কোটি টাকার ঘাটতিতে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৯৮০ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ১ হাজার ৪৯৯ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংক ৫২১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এদের মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া অন্য সব ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।

আইএফআইসি ব্যাংক মার্চ শেষে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ডেফারেল সুবিধা নিয়ে ঘাটতি অনেকটাই কমাতে পেরেছে ব্যাংকটি। ন্যাশনাল ব্যাংকও একইভাবে সুবিধা নিয়ে ঘাটতি কমিয়ে এনেছে—ডিসেম্বরের ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা থেকে মার্চে ৬ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকায়।

এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পেয়েও তার ঘাটতি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এবি ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় তার ঘাটতিও বেড়েছে—ডিসেম্বরে ছিল ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যা মার্চে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৭১ কোটি টাকায়।

যেসব ব্যাংকের আগে মূলধন ঘাটতি ছিল না, সেগুলোর মধ্যেও নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক। প্রিমিয়ার ব্যাংক মার্চ শেষে ১ হাজার ১৭১ কোটি, সীমান্ত ব্যাংক ২৬ কোটি এবং ইউসিবি (ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক) ৯৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। এ ছাড়া সিটিজেন ব্যাংক ৮৬ কোটি টাকার এবং হাবিব ব্যাংক (একমাত্র বিদেশি ব্যাংক, যা ঘাটতির তালিকায়) ৩৬ লাখ টাকার ঘাটতিতে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) মাত্র ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ন্যূনতম ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। যদি ব্যাংকগুলো ডেফারেল সুবিধা না পেত, তবে সিআরএআর ঋণাত্মক হয়ে যেত—প্রায় ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে, খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এই খেলাপির চাপে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি আরও বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একটি গভীর সংকটে রয়েছে। ডেফারেল সুবিধা এক ধরনের ‘চিকিৎসা’ হলেও এটি মূল রোগ সারানোর পথ নয়। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবই আজকের এ সংকটের মূল কারণ। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—এই খাতকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত রাখতে হলে ব্যাংক খাতে সংস্কার, জবাবদিহি এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এখনই সময় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে ২৩টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গভীর সংকটকে উন্মোচন করেছে। ডেফারেল সুবিধা দিয়ে সাময়িক চাপ লাঘব করা গেলেও এটি স্থায়ী সমাধান নয়। সিআরএআর ঋণাত্মক হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ইসলামি ব্যাংকগুলোয় দুর্বল ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম—এ অবস্থার মূল কারণ।

দ্রুততম সময়ে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করলে গোটা অর্থনীতিই ঝুঁকিতে পড়বে বলেও জানান এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

১০

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

১১

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১২

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১৩

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১৪

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৫

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৬

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৭

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৮

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৯

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

২০
X