মানবদেহের প্রয়োজনীয় আমিষের বড় অংশ আসে ডাল থেকে। আবার আমিষের চাহিদা পূরণের সহজলভ্য উৎসও হলো এ ডালই। উভয় কারণে ধনী-গরিব প্রায় সব পরিবারের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় ডাল হয়ে উঠেছে অপরিহার্য খাদ্য। কিন্তু অন্যান্য খাদ্যের মতো এই ডাল উৎপাদনেও স্বনির্ভরতার আসেনি দেশের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, একজন মানুষকে দৈনিক অন্তত ৪৫ গ্রাম ডাল খেতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) তথ্যমতে, দেশে ডালের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ২৮ লাখ টন। সে হিসেবে মাথাপিছু ৪৫ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে দেশে ডালের প্রাপ্যতা মিলে গড়ে ২৮ গ্রাম। অর্থাৎ বর্তমানে বিভিন্ন ডালশস্যের প্রাপ্যতায় মাথাপিছু ঘাটতি ১৭ গ্রাম বা ৩৮ শতাংশের মতো। ধান উৎপাদনে গুরুত্ব বেশি থাকায় ডালসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন কম হচ্ছে। ফলে এ ঘাটতি মিটিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে দেশকে ডালের উৎপাদন অন্তত ১৯ লাখ টন বাড়াতে হবে।
ডালশস্যের মধ্যে মসুর, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, অ্যাঙ্কর বা বুটের বা মোটা ডাল, ছোলা ও ছোলার ডাল রয়েছে। বর্তমানে এসব দেশে এসব ডালশস্যের মোট চাহিদার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হচ্ছে। সবশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডালজাতীয় শস্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৯৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বা ১০ হাজার ৩২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শঙ্কার বিষয় হলো: বছর যত গড়াচ্ছে, এই আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ডাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮১ হাজার ১৬৭ টন। সেটি ২০২১-২২ অর্থবছরে ডালজাতীয় শস্য আমদানি করা হয় ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৮ টন। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে ডালশস্য আমদানি প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়। আর আমদানি ডালশস্যের অর্ধেকই মসুর ডাল ও ছোলা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩০ টন মসুর ডাল এবং ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮০৫ টন ছোলা আমদানি করতে হয়েছে।
আমদানিতেও ধস: অতি সম্প্রতি ডালের আমদানি কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ডালজাতীয় শস্য আমদানি কম হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আমদানি হয়েছিল ৫ কোটি ৮৮ ডলারের এবং ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ২ কোটি ১৪ লাখ ডলারের ডালজাতীয় পণ্য। অর্থাৎ এ সময়ে পণ্যটির ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ আমদানি কমেছে।
চোখ রাঙাচ্ছে দামও: এদিকে চাহিদার বেশিরভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ায় খাবারপাতে অত্যাবশ্যকীয় এ উপকরণের দাম বছরের বেশিরভাগ সময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে আমদানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয় অনেকাংশে বেড়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে সব ধরনের ডালের দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে মসুর ডালের চাহিদা প্রায় ৬ লাখ টন। মাসে চাহিদা প্রায় ৪০ হাজার টন এবং রমজানের চাহিদা ১ লাখ টন। মসুর ডালের স্থানীয় উৎপাদন হয় ২ দশমিক ২ লাখ টন। বছরে আমদানি প্রায় ৪ লাখ টন। ছোলার বার্ষিক চাহিদা দেড় লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন ৪৬ হাজার টন। আমদানি প্রায় ২ লাখ টন। রমজান মাসে চাহিদা ১ লাখ টন এবং মাসিক চাহিদা ৫ হাজার টন।
রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডালের কেজি মানভেদে ১০৫ থেকে ১৩৫ টাকা, যা ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি (ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু সময়) ছিল ৯৫ থেকে ১২০ টাকা। এর আগের বছর ২০২১ সালে একই সময়ে (করোনার সময়) ছিল ৬৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এ ছাড়া বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা। অ্যাঙ্কর ডাল বা বুটের ডাল বা মোটা ডালের কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ২০২১ সালে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা এবং ২০২২ সালে ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি কেজি ছোলার বর্তমান মূল্য ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। রোজাকেন্দ্রিক দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তাসলিম কালবেলাকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার আমদানিনির্ভর হওয়ায় দেশ এখন বৈশ্বিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া পণ্য ও পণ্যের কাঁচামাল আমদানির পর অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াজাতকরণে সব পর্যায়ে তথা—গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি তেল ও কর্মচারী খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পণ্যের মূল্য বেড়েছে। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, তখন উৎপাদন খরচ কম ছিল। ফলে ওইসময় জিনিসপত্রের দামও কম ছিল।
ডালেও কি সিন্ডিকেট? দেশে ডালের বাজারজাত ও আমদানির বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ কারণে দেশের ডালকল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ডাল ব্যবসায়ীরা তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছেন। এতে করে বেশিরভাগ ডালকল বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সুমন ডাল মিলসের মালিক মো. নাসের উদ্দিন খান কালবেলাকে বলেন, পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের হাতে সব ব্যবসা ছিল। এখন হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে গেছেন। তারা আমদানি থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত ও খোলা ডাল দোকানে দোকানে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে প্রক্রিয়াজাত করণ খরচের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেশিরভাগ স্থানীয় ডালকল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কারখানা পরিত্যক্ত ও গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মূল্য সব স্তরে সমান হারে নির্ধারণ করায় প্রান্তিক উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
উৎপাদন বাড়ানোতেই সমাধান: এই পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ ডাল উৎপাদন বাড়ানোতেই সমাধান দেখছে সরকার। দাবি করছে, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা গেলে একদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিবছর সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এতে দেশের রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখায় সহায়ক হবে। অন্যদিকে দেশি ডালের স্বাদ বেশি। চাহিদাও বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো গেলে বাজারে ডালের দামও কমে আসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিষয়টি আমলে নিয়ে এখন উচ্চফলনশীল জাতের ডালশস্য উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গবেষকরা বরেন্দ্র, চরাঞ্চল, পাহাড়ি, উপকূলীয়, রেলসড়ক ও রাস্তার ধারে চাষের উপযুক্ত জাত নিয়ে কাজ করছেন। এতে উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন