মেহেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৫, ০৯:২১ এএম
অনলাইন সংস্করণ

‘মৃত্যুশয্যায়’ মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা

মেহেরপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। ছবি : কালবেলা
মেহেরপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। ছবি : কালবেলা

মেহেরপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। চিকিৎসকের অভাব, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বিকল অবস্থায় পড়ে থাকা এবং দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন জেলার প্রায় আট লাখ মানুষ। তবে বিদ্যামান পরিসরে যতটুকু সেবা দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর।

এক সপ্তাহ সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০০ রোগী অপেক্ষা করেন চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায়। এ ছাড়া ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি থাকছেন ২৭০ থেকে ২৮০ জন রোগী। শয্যা ছাড়াও অনেক রোগীকে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সব বেডসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের কিছু বেডে বাসা বেধেছে ছারপোকা।

আরও দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের যোগসাজশে ওষুধ এবং বিভিন্ন টেস্টের কিট বাইরে বিক্রির অভিযোগ স্টোরকিপার পলির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও বিগত ১৭ বছরের মতো এখনো তিনি বিভিন্ন মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে দাপটের সঙ্গে একই জায়গায় রয়ে গেছেন।

হাসপাতালের ওষুধ, খাবার সরবরাহ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ের টেন্ডার নিয়ে রয়েছে বিএনপি দুই গ্রুপের হাসপাতালে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা।

নতুন ভবনে শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম। পড়ে আছে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৮ তলা নতুন ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ভবন এবং ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চার তলা বিশিষ্ট সার্ভিস ভবন।

হাসপাতালে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি সচল রয়েছে। আর একটি মাঝে মধ্যে রিপেয়ার করে চালাতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স চালকও রয়েছেন একজন। আর একজনকে আউটসের্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ১০টি শয্যা থাকলেও, ছয় মাস ধরে হার্ট মনিটর ও অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফলে রোগীরা সঠিক পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এই ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ শিউলি মণ্ডল বলেন, মেশিনগুলো অকেজো হওয়ার পর বারবার লিখিতভাবে জানানো হলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে ভর্তি হন ৬৪০ জন। এর মধ্যে মাত্র ৪ জনের সিজারিয়ান অপারেশন হয় হাসপাতালে। আর হাসপাতালে সেবা নিতে আসা ৪৯২ জনকেই শহরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হয়েছে। গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়।

প্রসূতি ওয়ার্ডে দেখা যায়, সেখানে একজন সেকমো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। সেখানকার নার্স ইনচার্জ শিউলি সরকার বলেন, ‘গাইনি ম্যাডাম না থাকায় অনেক রোগীকেই হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ম্যাডাম নিজেও অপারেশন করছেন।’

২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে ওষুধ, খাবার, নার্স ও শয্যার বরাদ্দ ঠিক থাকলেও চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল কাগজে কলমে এখনও বরাদ্দ ১০০ শয্যা হাসপাতালের অনুপাতে। তবে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ৪২ জন চিকিৎসকের বরাদ্দ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২১ জন। আর যে ২১টি গুরুত্বপূর্ণ পদ শুন্য রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মেডিসিন, শিশু, সার্জারি, গাইনি, কার্ডিওলজিস্ট, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, প্যাথলজির মতো বিশেষজ্ঞ পদ। ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসারের ৭টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১ জন। মেডিকেল অফিসার ১১ জনের স্থলে কর্মরত রয়েছেন ৯ জন। উচ্চশিক্ষার জন্য আরও ৪ জন প্রেষণে বদলি হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। ফলে জুলাই মাস থেকে চিকিৎসক সংকট আরও প্রকট হবে।

সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসমত আরা কালবেলাকে বলেন, আগে র‍্যাবিস ভ্যাকসিনের মজুত ছিল না। মার্চ মাসে নতুন টেন্ডারের ওষুধ আসলে আমাদের বিভাগে ৯১০টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সেই মজুত থেকে আমরা মার্চ মাসে ২৩১, এপ্রিলে ৪১৪ ও মে মাসে ১৭৪ জনকে হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিয়েছি।

প্যাথলিজ বিভাগে একজনকে দিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। ফলে প্রতিদিন অধিকাংশ রোগী বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশি অর্থ খরচ করে টেস্ট করাচ্ছেন। ফলে সরকারি অল্প খরচের সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ ওমর ফারুক বলেন, পাঁচ জনের কাজ একজনকে করতে হচ্ছে। ফলে দিনে ৫০টির বেশি স্যাম্পল নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়াও সিভিল সার্জন অফিস থেকে বিদেশগামীদের মেডিকেল টেস্টের জন্য অতিরিক্ত কাজ করা লাগছে। যার ফলে হাসপাতালের রোগীদের বাইরে গিয়ে টেস্ট করাতে হচ্ছে। জনবল না বাড়ালে সব রোগীর টেস্ট করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, মে মাস থেকে কিট সংকটে ডোপটেস্ট করা বন্ধ রয়েছে। তবে এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫, মার্চে ২ ও এপ্রিল মাসে ২ জন ব্যক্তির ডোপটেস্ট করা হয়েছিল।

ওষুধের টেন্ডারের মাধ্যমে মাত্র কিছুদিন আগেই ১২ হাজার ডোপটেস্টের কিট আনা হয়। তবে সেগুলো হাসপাতালের স্টোরকিপার পলি হাসপাতালের অন্য কর্মচারীদের যোগসাজশে কালবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে জানতে স্টোরকিপার পলিকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না বলে ফোনটি কেটে দেন। এরপর প্রতিবেদক পরপর ৪ দিন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবেদককে দেখলেই তিনি দ্রুত স্থান ত্যগ করে অন্যত্র চলে যান।

হাসপাতালের আরএমও ডা. সউদ কবির মালিক কালবেলাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে জনবল ও চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। এই অল্প জনবল নিয়েই আমরা নিরলসভাবে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়াও ৪র্থ শ্রেণির জনবল সংকটের কারণে আমরা নবনির্মিত ভবনে কার্যক্রম শুরু করতে পারছি না।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শাহারিয়া শায়লা জাহান বলেন, চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকায় সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও বিদ্যমান জনবল নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। দালাল চক্র সরাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে শূন্য পদে জনবল নিয়োগের জন্য।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘এমপি হই আর না হই, হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে আছি’

উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে : স্বরাষ্ট্র সচিব

নৌবহরের কয়েকটি নৌযানে উঠে পড়েছে ইসরায়েলি সেনারা

ইনজুরটাইমের গোলে বার্সার বিরুদ্ধে পিএসজির জয়

গণতন্ত্রের বিজয়ের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য : মিন্টু

বড় জয়ে বিশ্বকাপ শুরু অস্ট্রেলিয়ার

সতর্কতা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’

ফিক্সিংয়ের চেষ্টা করে তামিম ভাইরা ব্যর্থ হয়েছেন : আসিফ মাহমুদ

গাজামুখী নৌবহর আটকে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান

গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, একই পরিবারের চারজন দগ্ধ

১০

আইএলটি২০ তে দল পেলেন সাকিব-তাসকিন

১১

সুমুদ ফ্লোটিলাকে থামিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজ, পথ পরিবর্তনের হুঁশিয়ারি 

১২

ভারতে ড. ইউনূসকে অসুর রূপে উপস্থাপন, ‘অসম্মানজনক’ বললেন ধর্ম উপদেষ্টা

১৩

গাজামুখী নৌবহর সুমুদ ফ্লোটিলাকে ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজ

১৪

বিএনপি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশির দল : প্রিন্স

১৫

বিএনপি সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী : আনোয়ারুজ্জামান

১৬

বিভিন্ন মন্দিরে শিশুদের মাঝে চকলেট বিতরণ

১৭

আ.লীগকে অচিরেই আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হবে : জুয়েল

১৮

কাজে আসছে না ১১ কোটি টাকার পানি শোধনাগার

১৯

পূজার ছুটিতে কুয়াকাটায় পর্যটকের ঢল

২০
X