

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তৃতীয় বছরে প্রবেশের পর ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা, সামরিক ভারসাম্য ও পশ্চিমা কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ পর্যায়ে ইউক্রেন এখন এক ধরনের ‘বিপৎসীমায়’ অবস্থান করছে—যেখানে সামরিক চাপে, মানবসম্পদের ঘাটতি, অবকাঠামোর ওপর হামলা এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি দেশটির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
সামরিক লোকবল সংকটে ইউক্রেন: ইউক্রেনীয় বাহিনী টানা যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির শিকার। বিশ্লেষকদের মতে, দনবাস ও জাপোরিজিয়া ফ্রন্টে ইউক্রেনীয় সেনারা মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে এবং কিছু এলাকায় তারা রাশিয়ার বেষ্টনী কৌশলের কারণে সীমিত অবস্থানে রয়েছে। যদিও এসব দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা কঠিন, তবু স্বীকার করতে হবে যে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে ইউক্রেনের জন্য মানবসম্পদ ও অস্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
রাশিয়ার লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে, যদি এ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সেবাদান ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঘটনা, পাল্টা অভিযোগ ও রাজনৈতিক উত্তাপ: ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কয়েকটি নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পোল্যান্ডের রেললাইন ধ্বংসের ঘটনা। ওয়ারশ-লুবলিন রেলপথে নাশকতার ঘটনায় প্রথমে পোলিশ কর্মকর্তারা রাশিয়াকে দায়ী করেছিলেন। পরে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক জানান যে, তদন্তে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে—যদিও তিনি দাবি করেন যে, তারা নাকি রুশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।
রাশিয়ার গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান প্রধান ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে লক্ষ্য করে ইউক্রেনীয় পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয়েছে।
হাঙ্গেরির তেল শোধনাগারে সন্দেহজনক ড্রোন উড়ে বেড়ানোর ঘটনা নিয়ে ইউরোপে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কিছু সূত্র দাবি করেছে, এটি ইউক্রেনের অভিযানের অংশ হতে পারে, যদিও ইউরোপীয় বেশিরভাগ সরকারই এ ধরনের দাবি যাচাই করতে সতর্কতা দেখাচ্ছে।
এ ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আর সীমাবদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, এটি ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক জোটগুলোর সমন্বয়েও প্রভাব ফেলছে।
কিছু বিশ্লেষকের দাবি, ইউক্রেনের সরকার বা নিরাপত্তা সংস্থা যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে ইউরোপে প্ররোচনা ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। তাদের যুক্তি—ইউক্রেনের সামরিক অবস্থান যতই দুর্বল হবে, ততই তারা ন্যাটোকে সরাসরি হস্তক্ষেপে টানার চেষ্টা করতে পারে।
তবে অধিকাংশ পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইউক্রেন ইচ্ছাকৃতভাবে ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রে হামলা চালাবে—এমন ধারণা অত্যন্ত অসম্ভব। এর কারণ— ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো পশ্চিমা সমর্থন, সেই সমর্থন ঝুঁকিতে ফেলার যৌক্তিকতা নেই।
ন্যাটো ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পাঠানো বা নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে জোট অত্যন্ত সতর্ক।
ট্রাম্প প্রশাসন কী করবে: যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রীয় শক্তি। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন ন্যাটোর মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেন সহায়তার ভার কমাতে চায় বলে মনে করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত সহজ নয়। তবে ন্যাটো সদস্যের ওপর সরাসরি আক্রমণ হলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য থাকবে সক্রিয় হতে।
মন্তব্য করুন