মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংকের কাছে টাকা এখন আরও আকর্ষণীয়

তারল্য সংকট
ব্যাংকের কাছে টাকা এখন আরও আকর্ষণীয়

কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার পর আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। অনেক ব্যাংক সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এর প্রভাবে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে ঋণের সুদহার।

জানা গেছে, সরকারকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া, অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় কম হওয়া এবং ডলার ব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকে রয়েছে তারল্য সংকট। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ঋণ ও আমানতের সুদহারে যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটি তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে ঋণের পাশাপাশি আমানতেও সুদের হার বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সুদের হার বাড়লে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কমবে। আবার টাকা ব্যাংকমুখী হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক ব্যাংকই এখন তারল্য সংকটে রয়েছে। অর্থাৎ বাজারে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, ব্যাংকগুলো তা জোগান দিতে পারছে না। এর বড় কারণ হচ্ছে নিট বৈদেশিক সম্পদ কম আসছে। এটা বেশি এলে কাউন্টার হিসেবে টাকাটা বাজারে চলে আসে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। আর এটা বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোর মোট তহবিল ব্যবস্থাপনাটা কম হচ্ছে। অর্থাৎ আমানতের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বাড়ছে না। তারপর যদি সরকার সেখান থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে একদিকে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বাড়বে, অন্যদিকে ব্যক্তি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে না। সরকারের সঙ্গে তো প্রতিযোগিতা করে ব্যক্তি খাত ঋণ নিতে পারবে না। এজন্যই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। সেটা যদি আরও একটু বাড়ে এবং সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে কম ঋণ নেয়, তাহলেই মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমে আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই। সেইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও স্থিতিশীল পরিস্থিতি নেই। ফলে ব্যক্তি খাতেও ঋণের চাহিদা খুব বেশি বাড়ছে না। তার পরও যে পরিমাণ চাহিদা আছে, ব্যাংকগুলো সেটাও মেটাতে পারছে না। কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা নেই।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এখন টাকাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছে। অনেক ব্যাংক এখন আমানত সংগ্রহে ১২ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। আমানতের সুদহার অনেকটাই নির্ভর করে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তারল্যের ওপর। এর পাশাপাশি সেই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকের আস্থা এবং সেবার মানের ওপরও নির্ভর করে সুদহার। আমানতের সুদহার অনেক বেশি বাড়লেও ঋণের সুদহার খুব বেশি বাড়ছে না। এখনো প্রায় সব ব্যাংকে সেটা ১৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সব ব্যাংক মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ঋণের সুদহার যেন খুব বেশি না বাড়ে। কারণ, বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করলেই হবে না, সেই ঋণ আদায় হবে কি না, সেটিও দেখতে হবে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন অনেকটাই কমে গেছে। আগামীতে সেটা আরও কমবে। এতে একদিকে ব্যাংকের স্প্রেড কমবে, অন্যদিকে আয়ও কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারও ব্যাংকের চেয়ে বেশি। ব্যাংকগুলো সেখানে বিনিয়োগ করেও আয় করছে।’

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর ডলার সংকট কিছুটা কমেছে। টাকার সংকট তৈরি হয়েছে অনেক ব্যাংকেই। অনেক ব্যাংকে নানা অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারও ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এখন উচ্চ সুদে টাকা ধার করছে। বিদায়ী অর্থবছরে সরকার ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে সংকট কাটাতে সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। আবার কোনো কোনো ব্যাংক মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়া কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। কোনো কোনো ব্যাংক সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমানত সংগ্রহ করছে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকের আমানতে। কেননা সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর পরও চাহিদামতো আমানত পাচ্ছে না বেশিরভাগ ব্যাংক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংক ঋণের সুদহার যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে আমানতের সুদ। এর পরও ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না। ব্যাংকে টাকার টানাটানি সামলাতে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও বড় অঙ্কের ধার নিচ্ছে। অন্যদিকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণও কমিয়ে দিয়েছে। আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন ঋণের চাহিদাও অনেক কমে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম প্রজন্মের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ করার শর্তে আমানত সংগ্রহ করছে। ব্যাংকটির ঋণের সুদ বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংকে আমানতের সুদ ১০ শতাংশে উঠেছে, ঋণের সুদ উঠেছে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশে।

অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতিতে আমানত নিচ্ছে। তাদের ঋণের সুদ বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। তৃতীয় প্রজন্মের যমুনা ব্যাংকে আমানতের সুদহার ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে উঠেছে। ব্যাংকটি ঋণের ক্ষেত্রে সুদ নিচ্ছে সাড়ে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত। চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংক পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণের শর্তে আমানত সংগ্রহ করছে। মধুমতি ব্যাংকও ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে আমানত নিচ্ছে। মধুমতি ব্যাংকের ঋণের সুদ বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।

সুদ হারের এই ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘১৩ বা ১৪ শতাংশে আমানত সংগ্রহ করলে অন্তত ১৬ বা ১৭ শতাংশে সেই ঋণ বিতরণ করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় এত বেশি সুদ দিয়ে তারা কি সেই ঋণ বিতরণ করতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে কীভাবে? এমন বাস্তবতায় গ্রাহকদের আমানতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই আমানতকারীদেরও ভালোভাবে জেনে-বুঝে আমানত রাখতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন সরকারের মূল লক্ষ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেই লক্ষ্যেই নীতি প্রণয়ন করছে। এজন্য আমানতের সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে দামি করা হচ্ছে। সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। এতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

এর আগে ব্যাংক চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ ও সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। আমানতের সুদের হার ঠিক করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ২০২২ সালে ডলার সংকট শুরু হওয়া এবং মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠে যাওয়ায় সুদের হারে সীমা তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। শুরুতে বিষয়টি আমলে না নিলেও গত জানুয়ারি মাস থেকেই সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সীমা তুলে দেওয়ার পর থেকেই বাড়ছে ঋণ ও আমানতের সুদহার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফারিয়ার পাশে দাঁড়ালেন বাঁধন

নুসরাত ফারিয়া কারাগারে

ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আহত ২ শতাধিক

আদালতে নুসরাত ফারিয়া

বদলে দেওয়া ইরাকি এক ‘নারীবাদীর’ গল্প

গৃহকর্মী মরিয়ম বিবিকে উদ্ধার করল পুলিশ

দিনাজপুরে ট্রাক-মাইক্রোবাসে সংঘর্ষে নিহত ২

খেলাধুলার উন্নয়নে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে : তারেক রহমান

বিশ্বে সবচেয়ে গরম এখন কোথায়?

ভক্তদের অপেক্ষা করতে বললেন রাশমিকা

১০

ঢাকার বাতাস আজও ‘অস্বাস্থ্যকর’ 

১১

শাবিপ্রবি শিক্ষককে হেনস্তা, সড়ক অবরোধ

১২

একসঙ্গে চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান, লক্ষ্য ভারত?

১৩

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৪

নড়াইলে বিএনপি নেতার গাড়িবহরে হামলা

১৫

এখন কী ভাবছে পাকিস্তান?

১৬

১৯ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৭

বুনিয়ান-উম-মারসুস / বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করল পাকিস্তান

১৮

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯

১৯ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X