ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে শিকার করছে বাগদা এবং গলদা রেনু পোনা। প্রভাবশালীদের শত কোটি টাকার বাণিজ্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাছের শত প্রজাতি। এর ফলে মেঘনায় দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির অতি পরিচিত মাছ। নষ্ট হচ্ছে জীব ও বৈচিত্র্য।
এই নিষিদ্ধ রেনু পাচারে জেলায় রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নেটওয়ার্কের মূল হোতারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকীমুদ্দিন, তজুমুদ্দিন উপজেলা ও চরফ্যাশনের প্রায় ৫০টি ঘাট।
গত ৫ আগস্টের পরে বেহাত হয়ে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিএনপির কাছে। একই পথে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বৈশাখ থেকে আষাঢ়, মাত্র এই তিন মাসে রেনু পাচার করে অবৈধভাবে শত কোটি টাকার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ওই চক্রটি।
এরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভোলা থেকে চরফ্যাশন পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের ঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রায় প্রতিদিন প্রত্যেক আড়তে জমা হওয়া ড্রাম ভর্তি রেনু সংগ্রহ করে রাতের আঁধারে ট্রাক, পিকআপ অথবা ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে করে নদী পথে হাত বদল হয়ে পাঠানো হয় যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মৎস্য বিভাগ, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ ২/১টি অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হচ্ছে না কোটি কোটি টাকার এই রেনুর অবৈধ ব্যবসা।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে ভোলার নদীগুলোতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেনু পোনার প্রজনন হয়। এসময় রেনু শিকারে রয়েছে সরকারি বিধি নিষেধ। কিন্তু এই বিধি নিষেধ অমান্য করে জেলে, শিশু ও বৃদ্ধ সবাই রেনু শিকারে মশারি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের জাল ব্যবহার করে এই রেনু পোনা ধরে তা একটি পাত্রে রাখা হয়। পরে নিখুঁতভাবে বাছাই করে চামচ বা ঝিনাই দিয়ে শুধু বাগদার রেনুগুলো আলাদা পাত্রে রেখে অন্য প্রজাতির পোনাগুলো মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়৷ এতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চিরচেনা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। ধ্বংস হয় জীব ও বৈচিত্র্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে গলদা-বাগদা রেনু শিকারের এ মহোৎসব।
রেনু শিকারি জেলে হানিফ জানান, একজন জেলে প্রতিদিন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ পোনা ধরতে পারে। প্রতিটি পোনা তাঁরা দাঁদন বিহীন আড়ৎদারের কাছে ১ টাকা থেকে দেড় টাকা দরে বিক্রি করেন। আড়ৎদাররা ৪০ থেকে ৫০ হাজার ধারণ ক্ষমতার বিশেষ ড্রামে করে রাতের আঁধারে স্থল বা নদী পথে চিংড়ি ঘের-মালিকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তারা প্রতিটি রেণু বিক্রি করেন ৯ থেকে ১০ টাকা দরে।
রেনু শিকারের জন্য ওই সব ঘেরের মালিকরা মৌসুমের শুরুতে প্রত্যেক আড়ৎদারকে অগ্রিম ঋণ দিয়ে থাকে। অগ্রিম ঋণ পেয়ে আড়ৎদাররা জেলেদেরকে দাঁদন দিয়ে পোনা শিকারে উৎসাহিত করেন।
দৌলতখানের রেনু পোনা শিকারি আবুল কালাম বলেন, চিংড়ির পোনা ধরা যে অবৈধ, তা তারা জানেন। কিন্তু বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই রেনু পোনা শিকার করতে হচ্ছে তাদের।
রেনু ব্যবসায়ী লোকমান, জামাল ও মন্নান জানান, মেঘনার গলদা ও বাগদা চিংড়ির পোনা অল্প সময়ে বড় হয়ে যায়। তাই যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে মেঘনার পোনার কদর বেশি। জেলেদের কাছ থেকে তারা রেনু পোনা কিনে গলদা ও বাগদা চিংড়ির ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। এ ব্যবসায় তাদের লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর সঙ্গে এই এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। প্রতি মৌসুমে এখানে শতাধিক কোটি টাকার বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা বিক্রি হয় বলে তারা জানান।
এ বিষয়ে দৌলতখান উপজেলা ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মনোজ কুমার সাহা বলেন, বাগদা রেনু ধরা সম্পূর্ণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে আমরা এসব জেলেদের সাথে মত বিনিময় সভা করে রেনু ধরা বন্ধের পরামর্শ দেয়া শুরু করেছি।
এ বিষয়ে দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়তি রানী কৈরি কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে মৎস্য কর্মকর্তার পদ শূন্য। তবে বোরহানউদ্দিন উপজেলা কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে বিষয়টি দেখার জন্য বলেছি। তবে আড়ৎদারদের ব্যাপারে কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা আমি দেখবো।
রেনু নিধন প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব কালবেলাকে বলেন, নদী থেকে বাগদা বা গলদা চিংড়ি রেনু ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রেনু ধরা থেকে জেলেদের নিরুৎসাহিত করতে উপজেলা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা নদীতে যখন অভিযান পরিচালনা করি তখন জেলেরা আমাদেরকে দেখলেই নদীর কিনারা থেকে পালিয়ে যায়। তবে গত ১৪ মে ভোলার লালমোহন উপজেলায় রেনু পাচারের সময় ১০ লাখ পিস চিংড়ির রেনু জব্দ করা হয়েছে। এ সময় পাচারের সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। বুধবার ভোর পর্যন্ত উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর পৃথক স্থানে মৎস্য দফতরের অভিযানে এসব চিংড়ির রেনু জব্দ ও পাচারের সঙ্গে জড়িতদের আটক করা হয়। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন