দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা থাকা জামায়াতে ইসলামী ফের ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন আশায় বুক বাঁধছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তার সরকারের পতনের পর তারা খুশি। অতীতে তাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে নিজেদের জনগণের কাছে আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে চান নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৭ আগস্ট রংপুরের পীরগঞ্জে ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। একইভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেটের বিয়ানীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের দেখতে যান তিনি। এসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায় সংগঠনটি।
জামায়াত সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরসহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। এসব নৈরাজ্য প্রতিরোধ, জনমনে স্বস্তি ফেরানো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। ছাত্র আন্দোলনে আহতদের খোঁজ নেওয়া ও মন্দির পাহারার পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মাইকিং, শান্তি সমাবেশ, মতবিনিময় সভা, লিফলেট বিতরণ, সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটি গঠনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন তারা। ঢাকা মহানগরীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে খাবার পানি, দুপুরের খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড করছে দলটি। পাশাপাশি আতঙ্কিত নাগরিকদের মাঝে স্বস্তি ফেরাতে সচেতনতামূলক প্রচার ও গণসংযোগ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ছাত্রশিবিরও সারা দেশে হিন্দুদের মন্দির পাহারা, শহর পরিষ্কারসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের কালবেলাকে বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে হিন্দুবিদ্বেষী দল হিসেবে অপপ্রচার চালানো হয়, অথচ দেশে হিন্দুসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সুরক্ষার জন্য জামায়াত প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে হিন্দুদের ব্যাপারেও দেশে একটি ধারণা প্রচলিত আছে—সেটি হলো, হিন্দু মানেই মনে করা হয় আওয়ামী লীগ। জামায়াতকে যেমন হিন্দুবিরোধী অপপ্রচার দেওয়া হয়েছে, তেমনি হিন্দুদেরও আওয়ামী লীগের একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য হিন্দুদেরও যেমন জামায়াতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে কাজ করতে হবে, তেমনি জামায়াতকেও হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগ এই ‘তকমা’ দূরীকরণে কাজ করতে হবে। আমরা হিন্দুসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সুরক্ষায় জামায়াতের পক্ষ থেকে দুটি দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছি। প্রথমত, রাষ্ট্রীয়ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন কমিশন করে হিন্দুসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা-নির্যাতনের বিচার করতে হবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে। গত ১৬ বছরে তারা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করতে পারেনি। এরপর চলমান ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ১ আগস্ট সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সরকার। দলটির নেতারা জানান, নির্যাতন-নিপীড়নের এমন কোনো স্তর নেই, যা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেনি। এর পরও তারা হাল ছেড়ে দেননি। বরং সময় ও পরিস্থিতি বুঝে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কখনো এককভাবে, কখনো যুগপৎভাবে লাগাতার আন্দোলন করে গেছেন।
শুধু তা-ই নয়, আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সাজা ভোগের মধ্যেই মারা গেছেন দলটির সাবেক আমির গোলাম আযম। দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
সূত্র জানায়, দলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অভিযোগ এবং শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নে ব্যাপক কোণঠাসা হয়ে যায় জামায়াত। এরপর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরে গোপনেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে জামায়াতে ইসলামী। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে জামায়াত। দলটির নেতাদের মতে, একসময় বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা থাকলেও সেসব ছাপিয়ে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন তারা। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানসহ শীর্ষ নেতারা সারা দেশে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াতে ইসলামী সবসময় জনকল্যাণে কাজ করেছে এবং এখনো করছে। আমরা এতদিন স্বাভাবিকভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পাইনি। আল্লাহ দীর্ঘদিন পর হলেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্ত করেছেন। আমরা দেশের জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই এগিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।