ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০২:৫৬ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৮:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘গণত্রাণ’ এক করেছে সবাইকে

অভূতপূর্ব সাড়া
‘গণত্রাণ’ এক করেছে সবাইকে

দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে; লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার! অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! কাজী নজরুল ইসলামের এই গানের কথার মতোই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সবাই এক হয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।

গত ২১ আগস্ট দেশে আকস্মিক বন্যার শুরু থেকেই দুর্গম এলাকা থেকে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা ধরনের মানবিক কাজ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ সর্বস্তরের মানুষজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ‘গণত্রাণ’ সংগ্রহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন।

গতকাল টিএসসি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, দিনমজুর-রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা বয়স, শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ে ছুটে আসছেন। সবার হাতে চাল, ডাল, আলু, তেল, খাবার স্যালাইন, লবণ, বিশুদ্ধ পানি, খেজুর, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটসহ নানা ধরনের শুকনো খাবার।

রয়েছে নগদ টাকা, কাপড়-চোপড়, লাইফ জ্যাকেট, শিশুখাদ্য, পশুপাখির খাদ্য, ওষুধ, স্যানিটারি প্যাডসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই। বিভিন্ন দুর্যোগে ঢাবি শিক্ষার্থীরা অনেকবার ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন; কিন্তু এবারের মতো বড় আয়োজন এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এদিন সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে দিনভর টিএসসিতে ছিল মানুষের ঢল। বিশেষ করে বিকেলে এখানে পা ফেলার জায়গা ছিল না। দিনভর ও রাতের একটি অংশ ত্রাণ সংগ্রহ চললেও এসব ত্রাণ প্যাকেজিং করতে সারারাত টিমভিত্তিক শ্রম দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এবং ত্রাণ সংগ্রহ করতেও রীতিমতো খেতে হচ্ছে হিমশিম। এ ছাড়া টিএসসি এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ ত্রাণ বহন ও প্যাকেজিং করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরাই।

জানা গেছে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগদ অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহের পর সারারাত প্যাকেজিং করে প্রতিদিন ভোরবেলায় ট্রাকভর্তি করে সেগুলো বন্যাদুর্গত এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। গত শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত মোট ২৫ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মোহাম্মদ মহিউদ্দীন বলেন, গত দুদিনে আমরা জনসাধারণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী যে যা পেরেছেন দিয়েছেন। শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত আমরা ২৫ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে পেরেছি। এরই মধ্যে টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া, গেমস রুম ও বারান্দাগুলো পূর্ণ হয়ে আছে। আজকে (শনিবার) রাতে আবারও ডজনখানেক ট্রাক বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাবে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠব।

স্বেচ্ছাসেবক শাকিল বলেন, এমন টিএসসি এর আগে আমি দেখিনি। শিক্ষার্থীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন দিনরাত এক করে। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছেন। মোটামুটি সব ধরনের জিনিস আমরা পাচ্ছি।

ত্রাণ দিতে আসা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সোয়াইব আলম বলেন, বন্যাকবলিত মানুষদের দেখে আমি খুব মর্মাহত। সবাই সব দিক থেকেই তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। সেদিক থেকে আমি এবং আমার এলাকার কিছু ভাই ও বন্ধু মিলে অল্প কিছু অর্থ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণত্রাণ সংগ্রহ চলবে। এতে মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দিচ্ছেন। এটিকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করছেন। এ টাকা খরচের পর সংগৃহীত টাকার হিসাব দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বন্যা শুরুর পর গত বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে গণত্রাণ সংগ্রহের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। বৃহস্পতিবার থেকে সংগ্রহ শুরু হয়। কর্মসূচির প্রথম দিনে নগদ পাওয়া যায় ২৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা। এ ছাড়া রাতভর প্যাকেজিং করে পণ্যভর্তি কয়েকটি ট্রাক দুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়। গত শুক্রবার নগদ সংগ্রহ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা ওঠে। অন্যদিকে, এদিনই ক্রাউড ফান্ডিং করতে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে টিএসসির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক কনসার্টের আয়োজন করা হয়। ভারতের পানি আগ্রাসনে আক্রান্তদের জন্য জরুরি সংযোগ শীর্ষক এই কনসার্ট থেকে ২১ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা এবং প্রায় ২০ ট্রাক সমপরিমাণ ত্রাণসামগ্রী সংগৃহীত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, কনসার্টটি প্রাথমিকভাবে আয়োজিত হতে যাচ্ছিল স্বাধীনতাকামীদের ফ্যাসিস্ট হাসিনা উৎখাত-পরবর্তী উদযাপন ও সামনের দিনের লড়াইয়ের রসদ হিসেবে। বন্যা পরিস্থিতি তা সম্পূর্ণ বদলে দেয়। পরে সেটি ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ও বন্যার্তদের ত্রাণের জন্য তহবিল সংগ্রহের আয়োজন হয়ে যায়।

এদিকে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা বন্যার্তদের সহায়তায় এক দিনের বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা স্বাক্ষরিত এক বার্তায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বন্যার্তদের সহায়তা এক দিনের বেতন দেবে।

অন্যদিকে, ফেনীতে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার ও সহায়তায় ত্রাণ বিতরণ করছেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ। দাগনভূঞা উপজেলায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে ট্রলার আরও দুর্গম এলাকায় যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, যেহেতু এখন রান্না করার পরিস্থিতি নেই, সেহেতু প্রথম ধাপে ২০ হাজার পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম ধাপের কিছু অংশের কাজ শেষ হয়েছে আজ (গতকাল)। এ ধাপে দুই কেজি খেজুর, দুই কেজি চিড়া, এক কেজি লবণ ও এক কেজি চিনি দিচ্ছি। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উদ্ধার তৎপরতা, যা প্রশিক্ষিত ও সংশ্লিষ্ট ইকুইপমেন্ট ছাড়া সম্ভব নয়। এ কাজটি বাংলাদেশ সেনা, নৌবাহিনীসহ অনেকে করছেন। স্থানীয়ভাবেও যার যার জায়গা থেকে সবাইকে উদ্ধার কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাই।

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় ধাপে আমরা আরও ৫০ হাজার পরিবারের জন্য শুকনো ও ভারী ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করছি। যার জন্য ৫০০ টন মালামাল কেনার কাজ সম্পন্ন করেছি। যার মধ্যে রয়েছে ২০০ টন চাল, ২০ হাজার বোতল তেল (২ লিটার), ৩০ টন খেজুর, ৩০ টন চিড়া, ৪০ টন ডাল, সাড়ে ২৭ টন লবণ, ১৫ টন চিনি, ২০ হাজার পিস পানির বোতল (৫ লিটার) এবং দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মোমবাতি ও দেশলাই। তৃতীয় ধাপে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ৪ হাজার পরিবারের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা থাকলেও সেটিকে বাড়িয়ে ৫ হাজার করা হয়েছে। ঘরহারা ৫ হাজার পরিবারকে টিন ও নগদ অর্থসহায়তা করা হবে।

গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় জেলা যুবদলের উদ্যোগে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। সংগঠনটির সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্নার নেতৃত্বে এ কর্মসূচিতে যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল করিম পল, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাজী জসীমউদ্দীনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দির কমিটি এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানসহ দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন উমামা ফাতেমা

খামেনির সঙ্গে অশোভন আচরণ বন্ধ করুন, ট্রাম্পকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজ বাড়িতে ইউপি সদস্য ও ভাবিকে কুপিয়ে হত্যা

ঢাকার আকাশ আজ কেমন থাকবে

ইরানকে আবার হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

টিভিতে আজকের খেলা

দুপুরের মধ্যে ৭ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১২ পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে ইরান : আইএইএ

ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প সত্যিই আগ্রহী: পুতিন

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১০

মুন্সীগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৪

১১

২৮ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১২

ভারতে আরও এস-৪০০ সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা

১৩

‘কাঁটা লাগা’ খ্যাত অভিনেত্রী আর নেই

১৪

১০ ঘণ্টার মধ্যে ছিনতাইকৃত মোবাইল উদ্ধার করল পুলিশ

১৫

২০ হাজার নিমগাছ রোপণের উদ্যোগ ঘোষণা আমিনুল হকের

১৬

শুভ জন্মদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৭

সকল ইসলামী শক্তির মধ্যে সমঝোতা হতে যাচ্ছে : গোলাম পরওয়ার

১৮

মিরপুরে ভাড়াটিয়ার ওপর বাড়িওয়ালার হামলা

১৯

‘তারেক রহমান আওয়ামী ফ্যসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সফল রূপকার’

২০
X