কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবেশ ছাড়পত্র আদায়ের চেষ্টা ধরে ফেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক ব্যক্তিকে হত্যার মামলায় আসামি করা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। একই ঘটনায় দুটি মামলায় সমানসংখ্যক জ্ঞাত আসামি থাকলেও শুধু অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যায় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তাকে দুই মামলাতেই দুবার করে আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাদী শ্রমিক দলের নেতা হলেও নেপথ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা।
জানা গেছে, ২০২০ সালে হাজেরা এগ্রোবেইজড কোল্ড স্টোরেজের (হিমাগার) ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেন কোম্পানিটির মালিক। যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে অবস্থিত হিমাগার পরিদর্শন করে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রাথমিক কাজ শেষ করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু বাদ সাধে ঢাকা জেলা প্রশাসন। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রে জেলা প্রশাসনের যে অনাপত্তিপত্র সংযুক্ত করা হয়, তা জাল হওয়ায় হিমাগারের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে জেলা প্রশাসন। তদন্ত শেষে ভুয়া স্মারক ব্যবহারের সত্যতা পাওয়ায় চার্জশিট দেয় পুলিশ। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এর জেরেই পরিবেশ অধিদপ্তরের তিন কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের চারজনের বিরুদ্ধে জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলনে এক ব্যক্তিকে হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে মামলা করা হয়। মামলা করেন শ্রমিক দলের নেতা আবু বক্কর।
মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণী থেকে জানা যায়, দুটি মামলা করা হয়েছে ১৮ ও ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন যাত্রাবাড়ীর কাজলা চৌরাস্তার মোড়ে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এতে দুই মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৪২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ভিন্নতা শুধু অজ্ঞাতনামা আসামির ক্ষেত্রে। ১৮ জুলাইয়ের মামলায় ৪৪২ জন আসামির পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা দুই থেকে তিন হাজার এবং ১৯ জুলাইয়ের মামলায় তিন থেকে চার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবী উল্লাহ নবীর মালিকানাধীন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের কাজীরগাঁও এলাকায় আদ-দ্বীন নবী টাওয়ারে অবস্থিত হাজেরা কোল্ড স্টোরেজ। এই হিমাগারের মালিক নবী উল্লাহর জামাতা কে এম সিরাজউদ্দৌলা খোকন। দুজনই বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। নবী উল্লাহ ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। জামাতা খোকন ৫০নং ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি। মামলার বাদী আবু বক্কর বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক দলের আহ্বায়ক।
মামলা প্রসঙ্গে আবু বক্কর বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময়ে যাত্রাবাড়ীতে যে মানুষ মারা গেছে, তারা আমাদের আত্মীয়-স্বজন হলে মামলা তো করবই। এখানে মানুষ মারা গেছে পুলিশের গুলিতেই। অভিযুক্ত অফিসারদের নির্দেশেই তো মারা হয়েছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে মামলা তো হবেই। নিহত জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কী ধরনের আত্মীয়তা রয়েছে—জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।
মামলায় ৭ নম্বর আসামি হিসেবে রয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মাসুদ হাসান পাটোয়ারী। যিনি বর্তমানে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে কর্মরত। মামলার আবেদনে তার পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে মাসুদ ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের একান্ত সচিব (পিএস)। সহকারী একান্ত সচিব কোনো পদ ছিল না।
এ বিষয়ে মাসুদ পাটোয়ারী বলেন, কে, কখন, কোন শত্রুতার বশে কী মামলা দিয়েছে—তা বোধগম্য নয়। আর হাজেরা কোল্ড স্টোরেজের বিষয়ে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কারণ আমি পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগদান করি ২০২১ সালে। আর মামলার ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে।
ঘটনা প্রসঙ্গে জানা যায়, বিএনপি নেতা নবী উল্লাহ নবীর জামাতা ছিলেন মাসুদ পাটোয়ারী। ২০১৮ সালে নবী উল্লাহর মেয়ের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। মাসুদ পাটোয়ারীকে হয়রানি করতেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এই মামলার ইন্ধনদাতা হিসেবে নবী উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে অভিযোগের বিষয়ে নবী উল্লাহ নবী কালবেলাকে বলেন, মামলায় কে কে আসামি—এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মাসুদ পাটোয়ারী ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার মেয়ের বর্তমান স্বামীর প্রতিষ্ঠান যেন পরিবেশ ছাড়পত্র না পায়, সেজন্য কলকাঠি নেড়েছিলেন। জেলা প্রশাসনকে দিয়ে সেই মামলা করিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন বলেই এখন ওএসডি হয়েছেন। তা ছাড়া তিনি খায়রুল হকের একান্ত সচিব ছিলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হতেই পারে। বক্তব্যের জন্য নবী উল্লাহর জামাতা খোকনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এই মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ইলিয়াস মাহমুদ। তা-ও আবার দুবার করে। তিনি এই মামলার ২৭ ও ৪১৩ নম্বর আসামি। ইলিয়াস মাহমুদ বলেন, হাজেরা হিমাগার পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসনের অনাপত্তিপত্র দিয়েছিল। তার স্মারক নম্বরে অসামঞ্জস্য থাকায় চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। এটাই কাল হয়েছে।
এই ছাড়পত্র প্রদানের সময় ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে সহকারী পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) মুক্তাদির হাসান। তাকেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। মুক্তাদির বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের মতো একটা স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে নিয়ে কিছু ব্যক্তি তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এসব ভিত্তিহীন মামলা করছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে এর সমাধান চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কী করণীয় আছে?
মামলায় আরও আসামি হিসেবে রয়েছেন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রফিকুল ইসলাম, ব্যবসা-বাণিজ্য শাখার অফিস সহকারী-কাম-মুদ্রাক্ষরিক মোশাররফ হোসেন, অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম, অফিস সহায়ক জাফর সিকদার। তাদের প্রত্যেকেই হাজেরা হিমাগারের চিঠিতে কেউ করেছেন স্বাক্ষর, কেউ চিঠিটি খসড়া তৈরি করেছেন, কেউবা চিঠি প্রেরণে যোগাযোগ করেছেন।
জেলা প্রশাসনের দায়েরকৃত মামলার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র রায় কালবেলাকে বলেন, সে সময় জালিয়াতির অভিযোগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। পরে তদন্তের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে ভুয়া স্মারক ব্যবহার সংক্রান্ত জালিয়াতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছিলাম। পরে চার্জশিটও দাখিল করেছি আদালতে।