সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রক্তের নানা পরীক্ষার রি-এজেন্ট সরবরাহ করে জেনেটিক ট্রেডিং। সব রি-এজেন্টই মেয়াদোত্তীর্ণ। ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে এগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। জেনেটিক ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে ভয়ংকর এই জালিয়াতির অভিযোগ নতুন নয়। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে ভিটামিন-ডিসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের নানা পরীক্ষায় ব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহ করে আসছে। এসব অভিযোগে এর আগে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো
তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে কোনো পদক্ষেপই জেনেটিকের এসব জালিয়াতি বন্ধ করতে পারেনি।
জানা গেছে, একই অভিযোগে কয়েক বছর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেনেটিক ট্রেডিংকে কালো তালিকাভুক্তও করে। ধানমন্ডির দুটি বেসরকারি হাসপাতালেও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহের বিষয়টি ধরা পড়ে। পরে তারাও জেনেটিক থেকে রোগ নির্ণয়ের রি-এজেন্ট কেনাকাটা বন্ধ করে দেয়। তবে কর্মচারীদের ম্যানেজ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রি-এজেন্ট সরবরাহ করছে জেনেটিক।
কালো তালিকাভুক্তির পরে প্রতিষ্ঠানটির মালিক একেএম কামরুজ্জামান ‘অর্গানিক ইন্টারন্যাশনাল’ নামে আরেকটি কোম্পানি খোলেন। তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব জালিয়াতির ব্যবসার পেছনে তার খুঁটি ছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি বজলুল হক। তার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে সখ্য হয় কামরুজ্জামানের। জালিয়াতির ব্যবসায় যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসপাতালে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহের বিষয়টি গোপন রাখতে একেএম কামরুজ্জামান তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শিক্ষাজীবনের মূল সনদ আটকে রাখতেন। তবু বিষয়টি গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। আগারগাঁওয়ের একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জেনেটিকের রি-এজেন্ট সরবরাহের নামে জালিয়াতির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেয়। তবে অভিযোগ জেনেটিকের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। কারণ, জেনেটিক ট্রেডিংয়ের এই অনিয়মের সঙ্গে ওইসব হাসপাতালের রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে টেকনোলজিস্টরা জড়িত ছিলেন। মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টের স্টিকারের বার কোড স্ক্যান করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ওইসব হাসপাতালের টেকনোলজিস্টসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। এ কারণে মোটা অঙ্কের টাকাও উৎকোচ নিতেন তারা।
সম্প্রতি (গত সপ্তাহে) বিএসএমএমইউতে রক্তের নানা পরীক্ষার রি-এজেন্ট সরবরাহ করে জেনেটিক। সরেজমিন দেখা যায়, ওসব রি-এজেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ। ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিএসএমএমইউ বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের নতুন বিভাগীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনিও তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. মোজাম্মেল হক কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি আমি বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। জেনেটিকের সরবরাহ করা রি-এজেন্ট আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগে কেনা হয়েছে। জেনেটিক মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহ করেছে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর ওই রি-এজেন্ট এবং পরীক্ষায় ব্যবহৃত তাদের সরবরাহ করা মেশিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। আমরা অবশ্যই সরবরাহকারী ও এর সঙ্গে জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।
প্যাথলজি বিভাগে কর্মরতরা জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় সঠিক ও নির্ভুল তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে চিকিৎসাও ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্পর্শকাতর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত এসব মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহ ভয়ংকর ধরনের জালিয়াতি। তাদের কারণে মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অধ্যাপক ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ বা মানহীন রি-এজেন্ট ব্যবহার করে কোনো পরীক্ষায় সঠিক ফল পাওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে বড় কথা, রোগ নির্ণয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে জেনেটিক কেন মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সরবরাহ করবে।
কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট ও সার্জিক্যাল পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেনেটিক ট্রেডিং। তাদের মোহাম্মদপুরের অফিসে বসেই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরবরাহের জন্য আমদানি করা মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টে নতুন ভুয়া স্টিকার লাগানো হচ্ছে। এই কাজে কোম্পানির হয়ে গোপনীয়তার সঙ্গে কাজটি পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন মুজিবুল হক। তিনি মূলত মেয়াদোত্তীর্ণ সব পণ্যের লেবেলিং বা স্টিকার তৈরির কাজটি করেন। অফিস কক্ষে রাখা কোল্ডস্টোর বা ফ্রিজারে রাখা মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রি-এজেন্ট। এসব পণ্যের গায়ে নতুন তারিখের স্টিকার লাগানোর দায়িত্বে থাকেন জেনেটিকের বিশ্বস্ত কর্মী সাদেক, মনজুরুল, নাহিদ, লিটন, কামরুল, কামাল, শেখরঞ্জন নাগ, মোশারফ হোসেন, শরিফ উদ্দিন, কাউসার, আশিক ও আলম। এরপর এই কর্মীরা গোপনীয়তার সঙ্গে কাজটি শেষ করে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। যে কোনো অভিযানে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে দুটি রেজিস্টার খাতা তারা ব্যবহার করেন। একটিতে ভুয়া স্টিকার লাগানো নতুন মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লিখে রাখা হয়, অন্যটিতে মেয়াদোত্তীর্ণের আসল তারিখ ও ভুয়া স্টিকারের দুই লেখা হয়। যাতে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট কোথায় সরবরাহ করা হয়েছে, তার হিসাব থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব পণ্য কেনাকাটায় কোনো কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জেনেটিকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। কালবেলার হাতে আসা বিএসএমএমইউতে রোগ নির্ণয়ের রি-এজেন্ট সরবরাহের একটি কার্যাদেশে দেখা যায়, ৪৭ ধরনের রি-এজেন্ট কেনার একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে জেনেটিককে। এসব রি-এজেন্টও মেয়াদোত্তীর্ণ বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের বিলের কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মোট বিলের ৩০ শতাংশ কমিশন দেওয়ার কথা বলেছে জেনেটিক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত বৃহস্পতিবার জেনেটিকের অফিস ভবনে গিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মালিক একেএম কামরুজ্জামান অফিসে নেই। বিকেলে তার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অফিসে যাচ্ছি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আপনাকে পাঁচ মিনিট পরে ফোন দিচ্ছি। এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।
জেনেটিক ট্রেডিংয়ের মালিক একেএম কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এরপর তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতির ছত্রছায়ায় এসব অনিয়মের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জেনেটিকের অফিসে অভিযান চালায়। সেখানে তারা অনুমোদনহীন মেডিকেল ডিভাইস ও রি-এজেন্টের সত্যতা পায়। কিন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় কোনো জরিমানা করতে পারেনি। অনুমোদনহীন মালপত্র জব্দের কথা জানায় অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শুলশান জাহান।